উপকণ্ঠ সাপ্তাহিক বিভাগ
উপকণ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা"
(ওয়েব ম্যাগাজিন)
প্রকাশ কাল:- 25/04/2021, রবিবার
সময় :- রাত 07:30 মি:
সভাপতি:- অরুণ কুমার ঘড়াই
সহঃ সভাপতি:- সেক আব্দুল মজিদ
সম্পাদক এবং
প্রকাশক:- সেক আসাদ আহমেদ
যুগ্ম সহঃ সম্পাদক :-
১) ইমরান খাঁন
২) শেখ মণিরুল ইসলাম
সম্পাদকীয় দপ্তর ::-
গ্রাম:- গাংপুরা ডাকঘর:- সাগরেশ্বর
থানা:- রামনগর জেলা:- পূর্ব মেদিনীপুর
সূচক-৭২১৪৪৬ পশ্চিমবঙ্গ ভারত
মুঠোফোন:- 9593043577
✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒
✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒✒
নিষ্ঠুর মহামারী
বিপ্লব গোস্বামী
প্রতি শতবর্ষ পরে
তুমি কেন এসো ফিরে
হে নিষ্ঠুর মহামারী !!
কখনো বা প্লেগ হয়ে
নয় তো কলেরা ভয়ে
নয় স্প্যানিশ নাম ধরি !!
এসেছে বার বার
করেছে নর সংহার
মৃত্যু মিছিল প্রতি বারই !!
কুড়িতে করোনা নামে
প্রতি নগর,শহর,গ্ৰামে
রূপ নিয়েছে অতিমারি !!
চারিদিকে হাহাকার
নেই কোন প্রতিকার
মৃত্যু হয়েছে ভারী !!
কেবল আতঙ্ক-ত্রাস
হায় ! নিয়তির পরিহাস
কেবল লাশের সারি !!
কারো বোন কারো ভ্রাতা
কারো পিতা কারো মাতা
কারো পুত্র নিছে কারি !!
শ্মশানেতে জ্বলে চিতা
পুত্র শোকে কাঁদে পিতা
শোকার্ত প্রতি বাড়ি !!
জানি না শেষ পরিণতি
কোথায় যে টানবে ইতি
অপেক্ষায় আছি তারই !!
(প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের স্মরণে)
মৃত্যুতে আমি
-শ্যামল কুমার সরকার
মৃত্যুর সাথে সেইদিন থেকে আজ
পর্যন্ত আছি আমি
কোলাকুলি দিয়ে; ধরেছি মৃত্যুসাজ--
আমি মৃত্যুকামী।
কত যে মৃত্যু চোখের সামনে করি
পার, শৈশবের সেই
মৃত্যুটা এলো কৈশোরে যখনি পড়ি;
'আমি' মারি আমাকেই।
মৃত্যু আমার সত্যধারায় চলে
যৌবনের মৃত্যুটা
হলেই, বৃদ্ধজন্ম আমাকে বলে,
'গেল আমার আমিটা!'
কবিতা
শব্দহীন শঙ্খ
কলমে ডঃ রমলা মুখার্জী
শব্দহীন আজ শঙ্খ-নিনাদ,
স্তব্ধ হয়ে গেল কবিতার ঝর্ণা।
সেই ঝর্ণা-ধারা অহরহ মনের জমাট কালো ধৌত করে বইয়ে দেয় অমৃত সুধা।
ঝুঁকে পড়া মেরুদণ্ড হয় সিধা,
মসৃণ হয় মরচে ধরা বিবেক।
জেগে ওঠে অতলান্ত চেতনা, শোষকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস।
তোমার প্রতিবাদী কলমের শেষ গদ্যগ্রন্থ "ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা";
সেটাই এ মুহূর্তে আঁকড়ে রেখে বলি,
তোমাকে ছেড়েও মনেতেই ধরে রাখবো অনুক্ষণ।
হে সত্যের ধ্বজাবাহী, সাম্যবাদী শঙ্খকবি তোমাকে শত প্রণাম।
বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকা এ অস্হির সময়ে আবার এসো ফিরে
কবিতার আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে।
শঙ্খ বাজুক আবার.....
অনুরণিত হোক মানুষের হৃদয়,
মনুষ্যত্বের দ্বার হোক উন্মোচিত।
কবিতা -
রবিবাসরীয়
পিনাকী মুখার্জী
রবি সংসার এক পরিবার ,
বিভাজন , হয়নি প্রজনন !!
ছোট সংসারে , প্রাণের প্রদীপ
হাতে , আমরাই ক'জন !!
শঙ্খধ্বনি মৌন আঁধারে , রাত্রি
শেষে রবির আলিঙ্গন !!
শরৎ মেঘে একাকী রবির ,
আজ অনেক আপনজন !!
মন ভেসে যায় , সুরের
ডানায় , তোমার জলসাঘরে !!
তোমার সুর অঞ্জলি দেয় ,
তোমার জল নূপুরে !!
ঐ সুরেতেই ধরেছে কোকিল ,
মিষ্টি মিলন আলাপ !!
শূন্য দুপুর , আগুন হাওয়ায়
স্বজন হারানো বিলাপ !!
কবি শঙ্খ ঘোষ প্রয়ানে
তাপস কুমার বেরা
নিভে গেল সূর্য
আকাশে |
অদ্ভুত অন্ধকার
চরাচর |
এ তিমির ভেদী
শঙ্খ কি আর
বাজবে না ?
জীবন দীপ জ্বেলে
কে করবে তবে
সন্ধ্যারতি ?
এ ঘোর অমানিশা কেটে
শঙ্খ বাদ্য সহকারে
ভোরের আলো কি
আর ফুটবে না ?
বাবুমশাই
মিলন পুরকাইত
সবিনয় নিবেদন' তোমাকে,
যদিও, 'তুমি আর নেই সে তুমি'!
'বাবুমশাই', কোনো এক 'যমুনাবতীর তীরে',
এক 'মহা নিমগাছ' রেখেছিল তোমায় 'আড়ালে' ঘিরে!
'ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু'!
অমর রবে তুমি হৃদমাঝারে, ভুলবো না তোমায় কভু।
তুমি বলেছিলে, '' চুপ করো, শব্দহীন হও ''
সেই তুমিই তোমার কথা রেখে নিঃশব্দে চলে গেলে!
তবু, তোমার তৈরি করা সেই শব্দ-ছন্দের 'খাল',
তোমায় বাঁচিয়ে রাখবেই, এই ত্রিতালে চিরকাল।
বুক পেতে বেশ শুয়ে আছো ঘাসের উপরে চক্রাবলে!
যে শহরে 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'!
মিথ্যে কথার সেই শহরেই,
তোমার নতুন 'পুনর্বাসন' হোক আজ তবে!
জামাই
অঞ্জলি দে নন্দী, মম
জৈষ্ঠ মাসে।
মেয়ে-জামাই কাছে আসে।
জামাই ষষ্ঠীর পর্ব।
জামাই তো শ্বাশুড়ীর গর্ব। (বানান - আমার)
শ্বশুর কেনাকাটি।
শালা-শালী মজা করে।
আদর-যতন এক্কেবারে খাঁটি।
ঘোমটা টেনে শাশুড়ী রান্না করে
পিঁড়িতে বসে রান্নাঘরে।
সুবাসে ম ম ম করে সারা বাড়ী।
এরপরে শাঁখা-পলা পড়া নিজের দুকরে,
জামাইকে তা পরিবেশন করে।
পোলাও, মাছ, মাংস, ভাজাভুজি, তরকারী।
পাখার বাতাস দেয়।
বেরোয় না তাই ঘাম।
জামাইকে কাছের করে নেয়।
পাকা কলা, কাঁঠাল, লিচু, আম,
তরমুজ, কাঁকুর, জামরুল, জাম।
দয়ের বাটি, মিষ্টির থালা।
খাতির, আপ্যায়ন ঢালা।
খেয়ে উঠে জামাই বাবাজীবন
শ্বাশুড়ী মাকে করে নমস্কার।
আর দুহাতে তাকে দেয় উপহার।
প্রতি বছর জামাইষষ্ঠী হয়।
যুগে যুগে যুগে এভাবেই
তো সম্পর্কের ধারা বয়।
এ কথা যে ইতিহাসই কয়।
সংসার চলে অন্তরের শুদ্ধ ভাবেই।
পরিস্থিতি
শ্রীকান্ত মালাকার
তোমার জন্য এখন আমি অপরিচিত মুখ।
তোমার জন্য হারিয়ে যাচ্ছে বন্ধুত্বের সুখ।
তোমার জন্য ডিগ্রি সব আছে ফাইলবন্দি।
তোমার জন্যই হয়েছিল আলিনগরের সন্ধি।
তোমার জন্য মন ভেঙে সংসার গড়ে কেউ।
তোমার জন্য হাসছে সে লুকিয়ে বেদনার ঢেউ।
তোমার জন্য কোন গায়ক বর্তমানে মুদি।
তোমার জন্যই এক শ্রেণীর হচ্ছে টাকার গদী।
তোমার জন্য বনবাসে জনদরদী নেতা।
তোমার জন্য হঠাৎ লাভবান হন কাঁচামাল ক্রেতা।
তোমার জন্য দিশাহীন জীব করে আত্মহত্যা।
তোমার জন্যই নির্ভীক কলম হারায় তার সত্তা।
তোমার জন্য কোন অপদার্থ হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ।
তোমার জন্য বলির ছাগল হয় অবুঝ কেষ্ট।
তোমার জন্য নরম হৃদয় হয়ে ওঠে কঠিন।
তোমার জন্যই মহাননেতা নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন সেদিন।।
ঝাউবন
বদরুদ্দোজা শেখু
বেড়াতে যাওয়ার ছিল বন্ধুর বাড়িতে
বন্ধুটি মহিলা ব'লে দ্বিধাও বিস্তর,
বস্তুতঃ এমন সুন্দরী বন্ধুর হাতছানি
নির্জন সৈকতে ঝাউবনের আলিম্পন যেন
ইতস্ততঃ দ্বিধান্বিত মনে বেরোলাম
পাহাড়ি রাস্তায়, পেরোলাম ব্যস্ত বাজারের
মোড়, সব্জি মন্ডির ফুটপাত ধ'রে
আমার লক্ষ্য শুধু বান্ধবীর দেখা পাওয়া,
আদৌ তার বাড়ি যাওয়া নয় ; হয়তো হঠাৎ
কোনো অলৌকিকতায় ভর ক'রে বুঝি
উদয় হবে সে এসে সামনে আমার ,
বলবে অম্লান হেসে, 'দেরী দেখে এসেই গেলাম' ।
বেঁচে যাই বেঁচে যাই তবে , এমন পাওয়াই আমি চাই, কাছে পাওয়া , বাড়ি যাওয়া নয়
পাহাড়ি সন্ধ্যার এই উতলা বাতাসে
আসুক সে আমার কাছে সম্মোহনে সদ্যঃ ঝাউবন ।।
কবিতা
উত্তরণ
শান্তি_দাস
জীবনের যত ঘাত প্রতিঘাত
পেরিয়ে যাবার আশায়,
আসে মোদের অনেক আঘাত
কেউ থাকে না নিরাশায়।
জীবনে পেরিয়ে যেতে হবে সাগর
পাহাড় নদী মনে ভাবনা,
সময় বহমান স্রোতের গতিতে
তবুও মনে জাগে সাধনা।
কামনা বাসনা জীবনের দোড়ে
সুখকে করি আহরণ,
জীবন যাত্রায় হাবুডুবু খেতে হয়
যদি না জানে কেউ সন্তরণ।
হতাশাকে চিরসাথী করে রাখলে
সময় তো পেরিয়ে যাবে,
জীবনের সব আশা আকাঙ্খা
পূর্ণ হবে না কোন কালে।
চাই মোদের আশা হোক পূর্ণ
করতে চাই উত্তোরণ,
তাই তো জীবন পথে চলতে
সুখটুকু করতে হবে আহরণ।
দুপুর
রাহাত জামিল
শুনশান নীরবতা আচ্ছন্ন দুপুরের বিলাসিতা,
প্রমোদের অথৈ সাগরে ডুব দিয়ে আয়েস
খুঁজেছিলাম পাকা ডুবুরীর মত।
মালঞ্চ থেকে সবচেয়ে সুন্দর ফুলের
সুঘ্রাণে সাজিয়েছিলাম অপ্রতিরোধ্য দুপুর।
কিম্বা মালির পরিপাটি করা পুষ্প কানন থেকে
বেলী ফুলের অর্ঘ্য সাজিয়ে বরণ করেছিলাম সৌখিন
মধ্যাহ্ন।
বহতা নদে ভেসে যাওয়া শ্যাওলার মতো
পেরিয়েছে সে সব হুড়মুড়িয়ে।
দিনান্তে আঁধারে ফিঁকে হওয়া সূর্যের মতো
বিচ্ছিন্নের ঘোমটা দিয়েছে এখন সেও,
নিষেধের অলিখিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দূরে সরিয়েছে দ্রৌপদী দুপুরের ঘনঘটা।
ভুলেছে হর্ষ মাখানো দুপুরের নিখাদ ভালোবাসা
আর বিভিন্ন রঙের অভিন্ন রামধনু।
হয়তো এখন সে আদুরে রাত খোঁজে,
কিম্বা মিশুকে বিড়ালের মত উষ্ণ বিছানা!
দিন যায় দিন আসে....
চিত্তরঞ্জন দেবভূতি
দিন যায় দিন আসে,সবার কথা মনে পড়ে,
এলো যে এমন দিন
ইচ্ছা অনিচ্ছায়
অনেকে বন্দী ঘরে৷
বেকুবের মতো কিছু লোক উদাসীন থেকে,
করোনা সংক্রমণে মরে৷
যাঁদের কর্ম করতে বাইরে বের হতেই হয়,
তাঁদের কথা আলাদা,
উদাসীন থেকে ,মাক্স না পড়ে,সামাজিক দুরত্ব রাখে না বজায়,
তাঁদের জন্য আরো জটিল হবে,
করোনাকে দেশে দেশে করা জয়৷
প্রতি শতাব্দীতে এমন ভাবেই বুঝি,
শুরু হয় মৃত্যু মিছিল?
আমরা বাঁচার পথ খুঁজি?
মানুষে মানুষে কি আর নেই আগের মতো মিল?
দশ —বিশ হাজার বছর আগে,
যখন পৃথিবীতে লোকজন ছিল না বেশী!
তখন ও কি মানুষ ছিল
মিলেমিশে?
আত্মীয়স্বজন বেড়াতে গেলে হতো খুশী?
নৈতিকতা? সে তো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে,
নীতিহীন ভাবে ঝগরা,মারামারি,এই সব যেন বড় হয়ে আছে!
সব কিছু ছাপিয়ে সাহিত্য জগৎ?
এখনো মনটা নিয়ে যায় মানুষের আরো কাছে৷
ভালো থাকুন সবাই,মনে জেগে থাক পবিত্র ভালোবাসা,
লেখক | লেখিকাগণ পাশে আছেন,
মনে তাই জাগে অনেক স্বপ্ন আর আশা৷
——————————————
আশার ছলনা
মহীতোষ গায়েন
একটি আশা বাতাসে উড়ছে
একটি চরছে আকাশে,
একটি আশা রাজনীতি করে
একটি হচ্ছে ফ্যাকাশে।
একটি আশা ভোট ময়দানে
একটি শুধুই খাচ্ছে,
একটি আশা রাহাজানি করে
রিগিং করতে যাচ্ছে।
একটি আশা যাচ্ছে প্রচারে
একটি করোনা ভুগছে,
একটি আশা খিদের জ্বালায়
ফুটপাতে পড়ে ধুঁকছে।
একটি আশা প্রেম করে মরে
একটি সাজায় বাসর,
একটি আশা সব লুঠে নিয়ে
বসায় নাচের আসর।
একটি আশা স্বপ্ন দেখাচ্ছে
একটি সুবিধা তুলছে,
সমস্ত আশা উঠেছে সাঁকোতে
সাঁকোটা ভীষণ দুলছে।
একটি আশা এগিয়ে আসছে
সুখ শান্তির জন্য,
সব আশারা অপেক্ষায় থাকে
আমজনতা ধন্য।
যদি
সত্যেন্দ্রনাথ পাইন
যদি হোও সুজন
তেঁতুল পাতায় ন'জন।
তোমরা ক'জন?
মেঘ বৃষ্টি রৌদ্র ছায়া
মোট চারজন।
থাকবি আমার সাথে?
ছায়াঘেরা মাঠে
কিংবা
হারিয়ে যাওয়া স্রোতে
চড়চড়িয়ে রোদে
নয়তো
ছাতা মাথায় বরষায়
প্রেম হারানোর ভয়ে
আনন্দে
নয়তো
অশ্রু পাতে।।
বিভাগ-কবিতা
পয়লা বৈশাখ
শংকর হালদার
চৈতের অবসান ,বৈশাখ তার রোদের রং বদলে
ঘোষণা করে, গ্রীষ্ম এখনও তার দখলে ।
একে একে ঋতুগুলো নিজেদের দেখে ফিরে
আভিজাত্য আর অহমিকা রয়েছে ওদের ঘিরে ।
হে নূতন, চিরবরণীয় তোমাকে করি বরণ
ধূপ দীপ পুষ্প আদি আর নানা আভরণ।
ছিন্ন করো দুঃখ দৈন্য ক্লান্তি বিভেদ বেড়া
কে'বা দেখাবে পথ বলো তুমি যে ছাড়া ।
সখা,সম্মুখে রয়েছ তুমি সময়ের প্রতি বাঁকে
স্বাগত জানায় কর জোড়ে আঠাশের পয়লা বৈশাখে ।
বাসন্তিকা
অনিন্দ্য পাল
আকাশে ও কিসের রং?
উৎসব মুখর!
হোক্ গে! চল বসন্ত মেখে নিই খুল্লম-খুল্লা
বাজারে প্যাকেটজাত টিপছাপ আর বিছানা-বদল
তাতে কি?
দ্রৌপদীরও তো ছিল পাঁচ-স্বামী!
চল চামড়াটা ডুবিয়ে আনি রক্তহীন ডুবজলে
চল বাসন্তী-নাভিতে চুমু খেয়ে আকণ্ঠ শুষে নিই
কাল-পেয়ালার মধু,
তারপর না হয় ভেবে দেখবো সুন্দরী সায়ানাইড
তোমার ক্লিভেজের খাঁজে লুকিয়ে রাখা যাবে কি না বিশ্বাসঘাতক রঙের জীবন্ত পুঁটুলি...
প্রেম-বসন্ত
অশোক কুমার রায়
আড়ালেতে.নড়ে চড়ে ঐ ছুঁড়িটা কে ?
ওরে নদু কৈ-রে আমার চশমাটা দে !
চশমা দিয়ে দেখে
বলছে দাদু হেঁকে
ছুঁড়ির সাথে ছোঁড়াটা বসন্তো-না রে !
কবিতাঃ
"স্মৃতি জ্বালাময়ী"
জুয়েল রুহানী
নূতন দিনের সম্ভাসনে
এ কোন মায়ার আচ্ছ্বাদন?
দূর অজানায় চলার পথে-
পেলাম সুখের সিংহাসন!
সুখের সিংহাসনে বসে
আমি হবো রাজা,
সুখ দিয়েছো তাই তোমাদের
দিব অনেক সাজা!
কল্পনাতে ছিলো নাকো
নানান রঙ্গের আল্পনা,
তোমরা আমায় যা দিলে ভাই
হৃদয় রাজ্যে অল্প না!
কাম্য এমন সুখের স্মৃতি
নূতন দিনের অামন্ত্রনে,
মিশবো মায়ায় ছন্দে অতি-
তোমাদেরই নিমন্ত্রনে!
অনুগল্প
স্কুলের নৈশভোজের সেই দিন টা
আব্দুল রাহাজ
সালটা দু হাজার চোদ্দো
তখন আমরা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি স্কুলে ঘোষণা হয় প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে মাছ ভাত খাওয়ানো হবে সবার মনে আনন্দ উচ্ছলতা দেখা দিয়েছিল সেদিন। আমার পাশে বসে থাকা একজন বলেছিল আহা কত দিন পর মাছ ভাত খাব। আমাদের স্কুলের চারপাশের এলাকা ছিল প্রান্তিক মানুষের বসবাস সেই সব পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েরা আমাদের স্কুলে পড়তো । যেদিন ঘোষণা হয় মাছ ভাত দেবে সেদিন স্কুলঘর ভরে গিয়েছিল খুব ভালো লাগছিল সেদিন সবার সাথে দেখা হয়েছিল । তারপর টিফিনের ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে সবাই মাছ ভাত খেতে যে যার জায়গায় বসে পরলো বেস তৃপ্তিভরে মাছ ভাত খেলো। আমার পাশে বসে ছিল একটা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র দেখলাম তার একটা বড় মাছ পড়েছে সে মাছটা অর্ধেকটা খেয়ে আর অর্ধেকটা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে সত্যি এই দৃশ্যটা কোনদিন ভোলার নয়। তারপর দিন তার সাথে দেখা হয়নি বোধহয় অত্যন্ত প্রান্তিক পরিবারের ছেলে । সেই নৈশভোজের কথা আজও মনে পড়ে যায় সত্যিই ওই দিন ছেলে মেয়ে গুলো একটু পেট ভরে খেতে পেয়ে ছিল সেদিন। ওই যে দৃশ্যটা আজও কোথাও যেন নিজেকে ভাবায় ওই নৈশভোজে মনে করিয়ে দেয় দুবেলা দুমুঠো খেতে পাওয়া ছেলে মেয়ের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেদিন। নৈশভোজের দিনটা আজও যেন বুকের মণিকোঠায় গেঁথে আছে যা থাকবে আজীবন।
প্রবন্ধ
শুধু উপদেশ নয়
ড. নরেন্দ্রনাথ নস্কর
নিজে যেমন সুস্থ হয়ে বাঁচবেন,
তেমনি নিজের আত্মীয় স্বজন, পরিবার, ও সর্বোপরি আপনার প্রতিবেশি বা শুভানুধ্যায়ীরা যাতে সুস্থ থাকেন সেটার জন্য কিছুটা দায়িত্ব আমাদের কম বেশি সবাইয়ের।
এখন নিশ্চয়ই বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন টিভি, রেডিও, ওয়াটস্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদিতে দেখতে ও শুনতে পাচ্ছেন যে মহমারী আবার দ্বিতীয় অধ্যায়ে নতুন রূপে ফিরে এসেছে সমগ্র পৃথিবীতে।
মাঝে কিছুটা বিরতি দিয়েছিল।
এই সুযোগে বেশির ভাগ মানুষও সাধারণ সতর্কতা নেওয়া, যেমন নাক মুখ ঢেকে মাস্ক পরা, যথা সম্ভব শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা, ও ভাল করে সাবান জলে হাত ধুয়ে নেওয়া ইত্যাদি, থেকেও অনেকখানি দুরে সরে গিয়েছিল। কেমন যেন সতর্কতাহীন ভয়হীন হয়ে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ বেপরোয়া মনোভাবে চলতে শুরু করেছিল।
বেশিরভাগ মানুষের ধারনা হয়েছিল এই রোগের প্রকোপ চলে গেছে, ও আর এই রোগ ফিরে আসবে না।
এই ভুল ধারনার সুযোগে ধীরে ধীরে এই রোগ ক্রমে বিস্তার হয়েছে। অনেকেই বুঝতে পারেনি বা চায়নি।
এই সুযোগে খুব সহজে করোনা রোগ বিনা প্রতিরোধে মহামারীর আকার ধারণ করেছে ও দেশে দেশে নতুন করে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করেছে।
এই মহামারী প্রতিরোধে শুধু সরকারের উপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত নয়।
সাথে সাথে আমাদেরও সবাইকে সরকার ও ডাক্তারবাবুদের উপদেশ মেনে চলতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে।
আগের নির্দেশ মত আবার বাইরে বেরোলে অবশ্যই নাক মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে ও যথা সম্ভব শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে ও সঙ্গে পরিস্কার সাবান জলে হাত ভাল করে হাত ধুতে হবে বা অলকোহল স্যানিটাইজারে হাত ঘসে নিতে হবে।
আসুন নিজের ও অন্যের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ও জীবন রক্ষার জন্য এই বিধিগুলো মেনে চলি ও মহমারী প্রতিরোধে দেশকে সাহায্য করি।
বিভাগ : বাংলা প্রবন্ধ
দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ
"""""""""""""""""""""""""""""""""
সৌম্য ঘোষ
""""""""""""""""""""""""""""""""
সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে সত্যের ও প্রেমের সাধনাই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস। এই দর্শন বেদান্তের সেই মূল মন্ত্র : "একং সদ্বিপ্রা বহুদা বদন্তি" এই তত্ত্বের মর্মবাণী। অর্থাৎ পৃথিবীর সব বস্তুই একই বস্তুর বিকাশমাত্র। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন থেকে বেদ-উপনিষদের মূল তত্ত্বের পরিচয় লাভ করেছিলেন। কিন্তু মায়াবাদী দার্শনিক কিংবা সন্ন্যাসীর মতো সবই শেষ পরিণতিতে ঈশ্বরে বিলুপ্ত হবে বলে ঈশ্বরের বিশ্বসৃষ্টিকে ‘স্বপ্নজগৎ কিংবা মায়ার আবরণ’ বলে ভ্রম করেননি কবি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে, শত উপলব্ধির প্রত্যক্ষ অনুভূতিতে জীবনসমুদ্ররূপ রূপনারাণের কূলে জেগে উঠে তিনি অনুভব করেছেন, এ জগৎ স্বপ্ন নয়, পরম বাস্তব। এই পরম বাস্তবের আয়নায় দেখেছেন নিজ রক্তের অক্ষরে আপনার বাস্তব রূপ। এই সুখ-দুঃখময় বিচিত্র শোভাসম্পদের আধার পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কবির কাছে পরম রমনীয় বলে মনে হয়েছে তাই। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন কবি। তাকে ভালোবেসেছেন প্রেমমুগ্ধ অন্তরের সর্বানুভূতি দিয়ে।
বিশ্বের সেই অন্তর্নিহিত শক্তি, যাঁর থেকে এই রূপময় পৃথিবী এবং সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি, সেই অন্তর্নিহিত শক্তিই হলো সমস্ত সৃষ্টির মূল সত্য। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের গতিবাদ। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব।
রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক অনুসন্ধান তাঁর রচনার একটি বিশেষ অংশজুড়ে। এই দার্শনিক আলোচনা তাঁর প্রবন্ধাবলীর একটি মূল আলোচ্য বিষয়। তাঁর ধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধসমূহ এবং শান্তিনিকেতন শীর্ষক প্রবন্ধগুলির প্রধান প্রেরণা দার্শনিক আলোচনা। এছাড়া বিক্ষিপ্ত আকারে সাহিত্য শীর্ষক প্রবন্ধে, পত্রালাপে এবং ছোট ছোট রচনায় দার্শনিক তত্ত্ব মূলস্থান দখল করে আছে। মানুষের ধর্ম শীর্ষক তাঁর ‘হিবার্ট বক্তৃতা’ একটি অমূল্য দার্শনিক রচনা। এই বক্তৃতামালায় তাঁর, সমগ্র দর্শনকে একত্রিত করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর কাব্য রচনায় অনেকাংশ দার্শনিক তত্ত্বকণিকা বুকে ধারণ করে আছে। দার্শনিক তত্ত্বই তাদের আধার।
রবীন্দ্ররচনা বিচিত্র ও বিপুল। রবীন্দ্রনাথের ভাষার মাধুর্য কল্পনার অভিনবত্ব, ভাবের গভীরতা, রসের প্রাণদর্শিতা বিস্ময়কর। ভিক্টর হুগো বলেছেন, ‘প্রতিভা ঈশ্বরের আত্মস্বরূপের বহিঃপ্রকাশ।’ বেদে ব্রহ্মকেও আত্মদা বলা হয়েছে। এ অপ্রেমেয় প্রতিভার আবির্ভাব মানুষের ইতিহাসে এক চিরস্থায়ী সম্পদ। আমাদের প্রয়োজন ক্ষুব্ধ অর্থহীন তুচ্ছতাজর্জর জীবনে পরিবর্তন ধারা অব্যাহত রাখা; কিন্তু সকল ক্ষুদ্র প্রয়োজনকে অতিক্রম করে যে মহা জীবনের দিব্য মহিমা আমাদের নিকট উদঘাটিত, তাহাকে যেন আমরা সত্যভাবে শ্রদ্ধা করতে শিখি। সংসারের প্রাত্যহিক জীবনের কৃত্রিমতার কালরেখাগুলি ধীরে ধীরে কালের ‘গহনে’ অন্তর্হিত হয়; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো তেজোদীপ্ত মনস্বী, তপস্বী রসিকের একটা পূর্ণ অবয়ব মহাকালের পটে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে আছে।
তাঁর কবিতা কখনও মর্তচেতনা, কখনও ব্যঙ্গ কৌতুক আবার কখনো প্রেম ও সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে বিশ্ব চেতনায় সমকাল সংলগ্ন হয়েছে। তিনি মরমী কবিও। কারণ উপনিষদের ঋসিসুলভ প্রত্যয় তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে। সুফিবাদের ধারা, কবির ও রামপ্রসাদ সেনের আলিঙ্গণ তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতা গ্রাম বাংলার বাউল ফকিরদের দ্বারাও সমৃদ্ধ হয়েছে। বাউলদের মনের মানুষের মতোই তিনি জীবন দেবতা সৃষ্টি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের গতিবাদ। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব। বেদ উপনিষদের গতিবাদ সহস্র সহস্র বছর পূর্বে এই অমোঘ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বসত্য সম্পর্কে সাধনার লব্ধ অভিজ্ঞতায়। উপনিষদের রচয়িতারা বারংবার তাই অমৃতের সন্তানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সামনে এগিয়ে চলার। বলেছিলেন---- এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো এবং এগিয়ে চলো অবিরাম। যতক্ষণ না তুমি পূর্ণের সাথে মিলিত হয়ে পূর্ণ হয়ে ওঠো হে অমৃতস্য পুত্র, ততোক্ষণ এগিয়ে চলাই তোমার ধর্ম।চরৈবেতি! চরৈবেতি! বিশ্বজগৎ এই পূর্ণতালাভের জন্যই ছুটে চলেছে আদিঅন্তহীন কাল ধরে। কারণ শক্তিমাত্রই গতিময়। বিশ্বের সব বস্তুই গতিময় তাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবি মন যেমন ইউরোপীয় তাত্ত্বিক গতিবাদের ব্যাখ্যায় তৃপ্ত হতে পারেনি, তেমনি বেদ-উপনিষদের সৃষ্টিতত্ত্বের অবিচলিত উপসংহারে পৌঁছেও অস্থির হয়েছে বারবার। কারণ অনন্ত গতিপ্রবাহে জন্ম থেকে নানান জন্মান্তরে যাত্রা করে অসীমের পানে ছুটতে ছুটতে পূর্ণতা লাভ করার জন্য লালায়িত হননি কবি। তিনি সসীম থেকে অসীমে এবং অসীম থেকে সসীমের খণ্ডতায় প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন বারবার। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---
"আমার কাব্য সাধনার একটিমাত্র পালা। সে পালার নাম সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধনের পালা।"
রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য তাঁর ভাব-গভীরতা, গীতি ধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা আধ্যাত্মচেতনা ঐতিহ্যপ্রীতি প্রকৃতি প্রেম, মানব প্রেম, ভাব-ভাষা ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র, বাস্তবচেতনা ও প্রগতি চেতনা। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে ঈশ্বর এক নিবিড় অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের মূল নিহিত রয়েছে মানব সংসারের মধ্যেই। তিনি দেব বিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী-ঈশ্বরের পূজার কথা বলতেন। উপনিষদের ধর্মীয় আরাধনার পথ বেয়ে মানুষের ধর্মে উপনীত হয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে।
রবীন্দ্রদর্শনে আমরা দেখি তিনি অনুভূতির পথের পক্ষপাতিত্ব করেছেন এবং তাঁর ক্ষেত্রে একে ঠিক অনুভূতির পথ বললে সঠিক হবে না। আমার মনে হয় তিনি যে পথ অবলম্বন করেছেন তাকে অনুভূতির অন্তর্গত একটি বিশেষ পথ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
একদিকে তিনি যেমন আকুল হয়ে ওঠেন অনন্ত সুদূরের ব্যাকুল বাঁশরির আহ্বানে ------- "আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী" বলে, তেমনি পরক্ষণেই মৃত্তিকা পৃথিবীর আকর্ষণে তাঁর অন্তর কেঁদে আকুল হয় নিরন্তর। অসীমের আহ্বান ছেড়ে জননী জগতের সাথে নাড়ির টান অনুভব করে ছুটে যেতে চান ধরণীর সুধাস্নেহমাখা কোলে----- "আমারে ফিরায়ে লহ সেই সর্ব মাঝে/যেথা হতে অহরহ অঙ্কুরিছে, মুকুলিছে, মুঞ্জুরিছে প্রাণ শতেক সহস্র রূপে/। গুঞ্জরিছে গান শতলক্ষ সুরে/ উচ্ছ¡সি উঠিছে নৃত্য অসংখ্য সঙ্গীতে।" পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির অস্তিত্বের ভেতরে নিজেকে বিকশিত দেখতে চান তিনি। তিনি জন্মান্তরে অবিরাম যাত্রা করে ফিরেছেন। রূপ হতে রূপান্তর পরিগ্রহ করতে করতে লোক হতে লোকান্তরে বিচরণ করেছেন জীবনের নানা পর্যায়ের ভেতর দিয়ে ---- "আমার পৃথিবী তুমি বহু বরষের/তোমার মৃত্তিকা সনে/আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে/অশ্রান্ত চরণে/করিয়াছ প্রদক্ষিণ সবিতৃমণ্ডল/অসংখ্য রজনী দিন যুগযুগান্তর ধরি।" বিশ্বের সবকিছুর জন্য এই যে বিপুল ভালোবাসা, বিশ্ব প্রকৃতির সাথে এই নিবিড় একাত্মতা, তার সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতায় কবির প্রাণে বিপুল জীবনের অনুসন্ধান জেগে ওঠা, এটা তো কেবল এক জন্মের সাধনায় সম্ভব নয়। জলস্থল, আকাশ বাতাস, লোক লোকান্তর, সর্বদেশকাল, সর্বসমাজে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করার এই প্রবল আকাঙ্খা তার কারণ অফুরান জীবনের পরশ দিয়ে বিধাতা তাঁকে গড়েছেন ------ "আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব/ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।"
রবীন্দ্রনাথের মতে, “নিছক সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান বা নিছক শক্তির আবিষ্কার বাহিরের বস্তু, তারা সত্তার অন্তরের নাগাল পায় না।” নিছক মনন বৃত্তির সাহায্যে যে জানা তার চেয়ে ব্যক্তিগত সম্বন্ধ স্থাপনের দ্বারা হৃদয়বৃত্তির সাহায্যে যে পাওয়া ঘটে, তা আরো গভীর আরো সমৃদ্ধ অনুভূতি- এটিই রবীন্দ্র দর্শনের একটি মূল ভাবধারা। রবীন্দ্রনাথ এ কথাই দার্শনিক ও সাহিত্যিক আলোচনায় বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক। তারচেয়েও বড় কথা তিনি জীবনরসের কবি। অসীম-সসীমের মিলনকে কবি অনুভব করেছেন প্রেমে ভালোবাসায়, রূপে রসে, গন্ধস্পর্শে, বিষাদে বেদনায়, সুখ-দুঃখে। সেটা তিনি অনুভব করেছেন সর্বানুভূতির ভেতর দিয়ে। কিছুই তাঁর কাছে তুচ্ছ নয় তাই। পৃথিবীর তুচ্ছতম ধূলিকণাও কবির কাছে পরম উপভোগ্য হয়েছে। সবই অভিষিক্ত হয়েছে সৌন্দর্যের নব নব উৎসরসে। সংসারের কোনো বন্ধন কিংবা আসক্তি পরিত্যাগ করে বৈরাগ্যের সাধনায় তিনি তাই ব্রতী হতে চাননি। তাঁর অন্তরস্থিত কবিচিত্তের প্রেমমুগ্ধ হৃদয় জগতের আনন্দযজ্ঞে পূর্ণতার অভিস্নানে সিক্ত হতে উৎসুক থেকেছে অবিরাম। এ কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতায় নানাভাবে বলতে চেয়েছেন যে পৃথিবীর সমস্ত বিষয় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবনের একাকীত্বের মধ্যে মানুষের মুক্তি নেই। বিশ্বেশ্বরকে এই বিশ্বের মধ্যেই অনুভব করতে হবে।।