সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০

আত্মমগ্ন কবি কালীকৃষ্ণ গুহ ----- এক আলোকবর্তিকার সন্ধানে

বিশেষ ধারাবাহিক প্রবন্ধ :

-------------------------------------

 প্রবন্ধ -----  কবি ও কবিতা 

  --------------------------------------

    আত্মমগ্ন কবি কালীকৃষ্ণ গুহ  -----  এক আলোকবর্তিকার সন্ধানে 


            সৌম্য ঘোষ


 

                   কবিও আলোর সন্ধান করেন। ‘অন্ধকার হতে উৎসারিত আলো’র পথে যাত্রার ইঙ্গিত তিনি দিয়ে যান। একজন কবির ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রথম কবিতার প্রথম শব্দই যদি ‘রক্তাক্ত’ হয় তবে আর বলার অপেক্ষা রাখে না কোন জটিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ভগ্ন মন্থনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়ে চলেছে।  

তিনি কবি কালীকৃষ্ণ গুহ। উত্তর জীবনানন্দ কালের কবিদের মধ্যে  অন্যতম। 

             জীবনানন্দ লিখেছিলেন-  "মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো ; কবিতা লিখবার পথে কিছু দূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে। তবে সময়চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে।“ ( কবিতা প্রসঙ্গে’, ‘কবিতার কথা’, নিউ স্ক্রিপ্ট, মাঘ ১৪১৯, পৃ. ৩৭ ) 

                 একজন কবি এই নতুন মূল্যবোধের চেতনাতেই অগ্রসর হন। কেননা সময় সমাজের সঙ্গে মূল্যবোধ ও পারিপার্শ্বিক সমাজ জীবন পাল্টে যেতে বাধ্য।কবি যেমন সময়ের কথা লিপিবদ্ধ করবেন তেমনি আপন মনগহনে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করবেন। কালীকৃষ্ণ গুহের প্রকৃতির স্বপ্নিল নিকেতনে এক অনলস বিচারণের স্বাভাবিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দের সার্থক উত্তরাসূরী হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও কালীকৃষ্ণ গুহকে প্রতিষ্ঠা করা বোধহয় শক্ত নয়। একজন দক্ষ কবির প্রকৃত কাজ সদা অলিখিত পাতা ভরে ফেলা, লিখিত পাতায় লেখা নয়। এই লিখিত পাতা বলতে আমি বলতে চেয়েছি অনুকরণ । তবে প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক। চেতনে অবচেতনে কাব্যপাঠের মধ্য দিয়ে যে কবিসত্তা গড়ে ওঠে সেখানে অনিবার্য ভাবে প্রিয় কবির শব্দবন্ধন, চিত্রকল্প উঁকি দেয়। কবিকে সচেতন ভাবেই সেই চেনাপথ অতিক্রম করে অচেনা, অজানা গলিপথ থেকে রাজপথে যেতে হয়। আর এই যাওয়ার পথ খুব সহজ নয়। জীবনানন্দ দাশকে সামনে রেখেই কালীকৃষ্ণ গুহ কাব্যক্ষেত্রে নেমেছেন, বেশ কিছুক্ষেত্রে সফল ভাবে নিজস্ব অতিক্রম করেছেন- কাব্যপাঠে এমনই অভিজ্ঞতা জানান দেয়।

                     কবিতায় তিনি কী লিখতে চান, দেখে নিতে পারি নিজস্ব বক্তব্য থেকেই --

-“ অজস্র স্মৃতির আলোড়ন ও নির্জ্ঞান নিয়ে অভিজ্ঞতার পুরাণ ও অন্তর্নিহিত ভাঙন নিয়ে ক্ষতবিক্ষত অবচেতন নিয়ে নারী ও শূনতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর কম্পন নিয়ে নিরন্তর নাক্ষত্রিক উৎসবের কিছু অন্ধকার নিয়ে যে জীবন কাটিয়ে এসেছি তা থেকে সঞ্চারিত কিছু বেদনাবোধ আর কিছু নীরবতার প্রতিবেদন ছাড়া অধিক কিছু পাবার নেই এইসব লেখায়।“ ( ভূমিকা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ, পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ- ডিসেম্বর ২০১৩ )

            এই ‘বেদনাবোধ’ ও ‘নীরবতার প্রতিবেদন’ ছাড়াও তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রকৃতিচেতনা। লাভ লোকসানের হিসেব নয় তিনি কবিতায় সত্য আবিষ্কারে মত্ত। জনপ্রিয় হতে চান নি, নিমগ্ন থেকেছেন আত্মপ্রেচষ্টায়, সেখানে বিচারণ এক সত্য- “ আমরা কবিতা লিখি, আমাদের ক্ষতি কিছু হয় না”( ‘ঝড়েশ্বর বাখরা’, ঐ , পৃ. ৩২)। কবিতাই কবির পরিচয়ের শ্রেষ্ঠ ধ্রুবক।     


                   লেখা শুরু করেছেন ছয়ের দশকে। ইতিমধ্যে বহুকাব্য প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল – ‘ রক্তাক্ত বেদীর পাশে’( ১৯৬৭), ‘ নির্বাসন নাম ডাকনাম’ ( ১৯৭২ ), ‘ হস্টেল থেকে লেখা কবিতা’ ( ১৯৮৪ ), ‘ হে নিদ্রাহীন’ ( ১৯৮৮), ‘ পিতামহ, খোয়াইয়ে এসেছি’ ( ১৯৯০), ‘ তোমার প্রবাহ, চৈতমাস’ ( ১৯৯১), ‘ ক্লান্তির ভিতরে এই শেষ’( ১৯৯৬), ‘ স্মৃতিহীনতার মধ্যে নিস্তব্ধ পুরাণ’ ( ১৯৯৯), ও ‘ বৃষ্টির ভ্রমণ’ ( ২০১২ )। কতগুলি পর্যায় ক্রমে আমরা তাঁর কাব্যপাঠে অগ্রসর হব।

               কবি কালীকৃষ্ণ গুহ প্রকৃতির অতলন্ত পরিবেশে মিশে থাকতে ভালোবাসেন। চেনা জানা প্রকৃতির নিবিড় গহীন গাঙ থেকেই তাঁর কাব্যস্বর উচ্চারিত হয়। এক নস্টালজিক মন মৃদু স্পর্শে ভাববিশ্বে রূপায়িত হয়। সেখানে তিনি আর কোন আড়াল খোঁজেন না। অবচেতন বিশ্বে নিজস্ব স্বর থেকে বহুদূরে প্রসারিত হয়ে যায়। প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব স্বদেশ থাকে। তাঁর কবিতায় একটা জার্নি আছে, সেখানে প্রাপ্তি বলে কিছু নেই শুধুই অনুভূতির এক গদ্যসত্তা বিরজামান-


“ রাত্রির ভিতর দিয়ে হেঁটে গেছে মানুষ, এইতো তার ভাষা –

তার অভিজ্ঞতা এই পাথরের মধ্যে আছে,

মৃত্যু এবং জন্মদিন আছে, প্রিয়তমা নারীর মুখ আছে, রাগিণী আছে।

এইখানে এসে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে, সময়ের অস্পষ্ট শিলালিপি

পড়ে দেখতে ইচ্ছে করে, বলতে ইচ্ছে করে :”

( ‘পর্যটন’, ঐ, পৃ. ২১ )

                স্বপ্ন, বিচ্ছেদ, বিশ্বাস ও বিশ্বাসভঙ্গ সমস্তকেই তিনি প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। আকাঙ্ক্ষিত মন নিয়ে অন্ধকারে বিরজামানসত্তা এগিয়ে আসে আলোর পথে। কখনও বা শুধু স্মৃতি নির্ভর জীবনসমুদ্র মন্থনে অগ্রসর। তাঁর স্মৃতি রোমন্থনে একাকিত্ব আছে কিন্তু একাকিত্ব থেকে বাঁচতে প্রকৃতিই বড় সহচার্য হয়ে উঠেছে। 

        নগর কলকাতার নিয়মতান্ত্রিক জীবনের ক্লেদ গ্লানিই হয়ে উঠেছে কবিতার সত্য। কিন্তু এই ক্লান্তবিধুর অবস্থা থেকে কবি পরিত্রাণ চেয়েছেন। নৈঃশব্দের অন্তঃলোকে বিচরণ করতে চেয়েছেন-


“ আজ সন্ধায় আবার তোমার কাছে কেন ফিরে এলাম, কার্তিকের মাঠ ?

গত দশবছর ধরে অনেক তর্কের পর তোমার এইসব পুরোনো

গাছগুলির কাছে কেন ফিরে এলাম আবার ?”

( ‘কার্তিকের মাঠ’, ঐ, পৃ. ৩০ )

            কবি তো জীবনের জয়গানই গেয়ে চলেন। জীবনের ত্রিবিধ স্বরান্তের ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেন। কবিতার শুরুই হয়েছিল বাল্মীকির যে শ্লোক দিয়ে সেখানে ছিল প্রকৃতির দৃশ্য। সে কাল থেকে একাল অবধি বহু কবি বৃক্ষকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তারপরও একজন কবি কেন বৃক্ষকে নিয়ে কবিতে লিখবেন ? আসলে কবি তো কবিতায় নিজের অনুভূতিকেই ব্যক্ত করতে চান। হৃদয় মন্থনজাত সে অনুভূতি অবশ্যই পৃথক। তাই বহু কবিতার পরেও কবি ‘বৃক্ষ’ কবিতায় ব্যক্ত করেন-


“ তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, বৃক্ষ।

বলা হয়েছে, তোমার পবিত্রতার ভিতর থেকে নিয়তি মাথা তোলে, তার

পুরোনো মুখ তোলে।

অজস্র কবির কাছে ঋণ রয়েছে তোমার।

বৃক্ষ, আজ তুমি আমার ঘুমের মধ্যে শান্ত ডালপালা ছড়িয়ে দাও

যথাযথ নির্জনতা দাও

( ‘বৃক্ষ’, ঐ, পৃ. ৩২ )

         জীবনানন্দ হেমন্ত সচেতন, কালীকৃষ্ণ গুহের কবিতায় শরৎকালের প্রাধান্য। তবে এখানেও রয়েছে ক্লান্তি ও অন্ধকারের ইঙ্গিত। তবে এই ক্লান্ত জীবনের মধ্যেই রয়েছে নতুনের হাতছানি। পরিশীলিত ভূগোলের মধ্যেই কবি সুখের সন্ধান করেছেন। সে অনুসন্ধান এসেছে নবজাতকের আগমনের মধ্য দিয়ে। কখনও আবার চিত্র আঁকেন। সে চিত্রে মিশে থাকে ক্ষয়িষ্ণু সময় ও মূল্যবোধের ধূসর পাণ্ডুলিপি।  আর স্বগত আত্মকথনে উচ্চারিত হয় –


“ নিঃসঙ্গ দিন যায়। দীর্ঘ দুপুর

গ্রীষ্ম

ধুলো উড়িয়ে আনে।

শিশুবর্ষের এক একটি দিন যায় – নিঃসঙ্গ ধুলো –ওড়া দিন

শুধু মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বোদলেয়রের মুখ,

র‍্যাঁবোর মুখ, আর “

( ‘গ্রীষ্মের দুপুর’, ঐ, পৃ. ৩৭ )


               কবিতার সত্যে, ব্যক্তি অনুভূতির সত্যে, আলোর সন্ধানেই  আনন্দধারা বর্ষিত হয়। সমস্ত মুছে দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন –


“ বৃষ্টি আনে প্রতিশ্রুতি, খণ্ড অন্ধকার

বৃষ্টি আনে ভয় আর দৃশ্যের আড়াল আর বিলুপ্ত শৈশব

বৃষ্টি আনে রজস্বলা রমণীর গান, পরচুলা

বৃষ্টি আনে স্বগতোক্তিময় এক উন্মাদ রচনা

বৃষ্টি আনে অন্ধত্বের পাশাপাশি বেড়ে ওঠা দেবদারুগাছ”

( ‘তোমার প্রবাহ, চৈত্রমাস’, ঐ, পৃ. ৬৩ )


                  কালীকৃষ্ণ গুহ লেখেন –“ অদ্ভুত এক ঝিঁঝির ডাক নির্ধারিত করে দিচ্ছে এই সময়কে।“ ( ‘এই গ্রহ’, ঐ, পৃ. ৭২ )

                 আনন্দসত্তা পূর্ণ বিকশিত হয়েছে প্রকৃতির মধ্যেই –

“ জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছে মাঠ গাছপালা বাড়িঘর সঙ্ঘ অতিথিশালা

জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছে দীর্ঘ সব শালবন

জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছে ব্রিজ মূর্তি অগণিত ধর্ম- পাতাকা

জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমাদের পাপের ভিতরে

জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমাদের পাপপুণ্যের অতীত সব জিজ্ঞাসায়

জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমাদের স্মৃতিতে, কামনাবাসনায়”

( ‘ সুদূর অতীতকালের মধ্য থেকে কাক ডাকছে’, ঐ, পৃ. ১২৭ )


           কবি সেখানে মিশে যেতে চান-

“ যখন কিছু ভেবে- ওঠার আগেই বৃষ্টিতে ভিজে যাও তুমি

যখন তোমার অতীতকালও বৃষ্টিতে ভিজে যায়

যখন মল্লার গাওয়া হয় নিরবধিকালের নৈঃশব্দ্যকে বোঝানোর জন্য

তখনো আঘাত আসে।“

( ‘আঘাত’, ঐ, পৃ. ১৩৩ )


                    কাব্যযাত্রায় তিনি জীবনানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হলেও অচিরেই নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়েছেন। ফলে শব্দসজ্জা, চিত্রকল্প ও উপস্থাপন রীতিতে এসেছে অভিনবত্ব- এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, এখানেই তিনি কালজয়ী শিল্পী।


__________________________________________


লেখক :----  অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ । চুঁচুড়া। হুগলী।

সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০

গবেষণা মুলক প্রবন্ধ কবি ও কবিতা : রফিক আজাদ: "আব্বাজান" সৌম্য ঘোষ

গবেষণা মুলক প্রবন্ধ  কবি ও কবিতা :  রফিক আজাদ:  "আব্বাজান"    সৌম্য ঘোষ

 গবেষণা মুলক প্রবন্ধ
 কবি ও কবিতা :
 রফিক আজাদ:  "আব্বাজান"
           সৌম্য ঘোষ

   



"বালক ভুল করে নেমেছে

ভুল জলে

বালক পড়েছে ভুল বই

পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই"

                       —রফিক আজাদ


ভুল জলে নেমে পড়া ভুল বালকের জন্য কি এক মর্মছেঁড়া হাহাকার নেমে আসে বুক জুড়ে! ব্যাকরণ পড়াই হলো না, মূল বইও। তবু ভুল বই ধরে ধরেই চলে গেল এতটা কাল! চলে গেল! চলে গেলেন কবিতায় জীবন পার করা নির্ভুল বালক রফিক আজাদ! বসন্তে এসেছিলেন তিনি, চলেও গেলেন বসন্তে।


বসন্তছোঁয়া জন্মের জন্যই বুঝি তাঁর কবিতা এত বসন্ত-মাখা! ভালোবাসা তাঁর কাছে এমনই এক সঞ্জীবনী—যা পেলে তিনি শুধরে নিতে চান ‘জীবনের ভুলগুলি’। কিন্তু জীবনের ‘ভুল বইগুলো’ই তো তাঁকে রফিক আজাদ করেছে। ‘ভুল বই’ থেকে পাঠ নিয়ে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে যাওয়া কথার পরেও মুখোমুখি বসে থাকা।’ প্রেম নিয়ে এ রকম উপলব্ধি তুলনারহিত। এই উপলব্ধি এতটাই চেতনপ্রবাহী, এতটাই প্রভাবসঞ্চারী যে, কবিতার লাইন থেকে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে আজ প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। কবি কতটা বিস্তারী হলে এ রকম হতে পারেন, এর উজ্জ্বল উদাহরণ কবি রফিক আজাদ।


তিনিই প্রথম ‘অপেক্ষা’ এবং ‘প্রতীক্ষা’ শব্দ দুটোকে আভিধানিক অর্থ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। পার্থক্য গড়িয়ে দিয়েছেন। দেখিয়েছেন শব্দ দুটি কিভাবে আভিধানিকতা থেকে পৃথক হয়ে ভিন্নতর দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয় । রফিক আজাদের হাত দিয়েই রচিত হলো ‘অপেক্ষা’ আর ‘প্রতীক্ষা’র ভিন্নার্থিকতা।


কবি রফিক আজাদের জন্ম টাঙ্গাইলে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’। এরপর একে-একে প্রকাশিত হয়েছে ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে’, ‘বিরিশিরি পর্ব’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘কবিতা সমগ্র’, ‘হৃদয়ের কী বা দোষ’, ‘কোনো খেদ নেই’ ইত্যাদি। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮১, লেখক শিবির পুরস্কার-১৯৭৭, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার-১৯৮১, কবিতালাপ পুরস্কার-১৯৭৯, কবি আহসান হাবীব পুরস্কার-১৯৯১, কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার-১৯৯৬, একুশে পদক-২০১৩।


তিনি শুধু ভালোবাসার কথাই বলেন না। সম্মুখযোদ্ধা এই কবি ঠিকই উপলব্ধি করেন ‘দেয়ালে দেয়ালে অনিবার্য অন্ধকার,’। সেই অন্ধকারের স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে দেখেন বীভৎস সত্যের আচ্ছাদন। মানুষের মৌলিক উপলব্ধির গভীর জগতে তিনি চলে যান। পাঠ করেন নির্মল সত্য। এই সত্য তাঁকে বলতে বাধ্য করে :

 ‘ভাত দে হারাম জাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’।


 এরকম আগ্রাসী মনোভাবের মাধ্যমেই তিনি ইঙ্গিত করেন মানুষের প্রকৃত মৌলিক স্বাধীনতার কথা। ভৌগলিক স্বাধীনতাই একমাত্র মুক্তির মাধ্যম নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি এখানে এক গুরুত্বপুর্ণ অনুষঙ্গ।


শেষাবধি মানুষেরা হিংসা দ্বেষ ভুলে পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে ।


তাঁর আরেক কালজয়ী কবিতা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। পনেরোই আগস্টের মর্মন্তুদ ঘটনা তাঁকে খুব তাড়িয়ে ফিরছিল। তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না একটুও। তখন রাজধানী থেকে বের হয়ে তিনি চলে যান চুনিয়া গ্রামে। তারপর লেখেন—‘চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনে প্রাণে/ নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে/ চুনিয়া বিশ্বাস করে/ শেষাবধি মানুষেরা হিংসা দ্বেষ ভুলে/ পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে।’ কতদিন আগে লেখা কিন্তু আজও কী সম-সাময়িক! একেই বোধহয় বলা হয় কবির তৃতীয় নয়ন। যে নয়ন দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দূর ভবিষ্যতের সমূহ অসম্পুর্ণতা। তাই আশার কথা শোনাতেও তিনি ভুলে যাননি। একজন প্রকৃত কবির কাজ শুধু অন্ধকারের রপ বর্ণনা করাই নয়, অন্ধকারের আচ্ছাদন আবিষ্কার করে আলোর কথা বলা, আশার কথা শোনানোও তাঁর পবিত্র কাজ। রফিক আজাদ সেই কাজটিই করেছেন আজীবন। এক জীবন তিনি ব্যয় করলেন শুধু কবিতার জন্যই। তাঁর প্রত্যাশার বাস্তব রূপ আজ বড় বেশি প্রয়োজন। আজকের এই বিভক্ত সমাজ একতায় আশাবাদী হতে চায়।


স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক ক্রান্তিকাল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণেও এক রকম নিষেধাজ্ঞা ছিল, সে-সময় তিনি লিখলেন, ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/ সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে/ বত্রিশ নম্বর থেকে/ সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে।’


এরকম সাহসী ছিলেন তিনি। 


কী ভাষা থাকতে পারে আমাদের তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর! আমি বাক্যরহিত । আমার অন্যতম প্রিয়কবি রফিক আজাদ , যাকে "আব্বাজান" ডাকা যায় ।।

___________________________________________


লেখক :--  অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া।  হুগলী ।

                 ১৩-১২- ২০

__________________________________________



মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০

প্রবন্ধ কবি ও কবিতা বুদ্ধদেব বসু প্রেমিক-সত্তায় কবি

প্রবন্ধ  কবি ও কবিতা  বুদ্ধদেব বসু  প্রেমিক-সত্তায় কবি


        প্রবন্ধ  কবি ও কবিতা

  বুদ্ধদেব বসু ------  প্রেমিক-সত্তায় কবি
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''""""""""""""
                  সৌম্য ঘোষ
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""

              উত্তর-রৈবিক পর্বের আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনে একটি স্মরণীয় নাম,  বুদ্ধদেব বসু । "কল্লোল যুগের" অন্যতম তরুণতম প্রতিনিধি হলেন বুদ্ধদেব । আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর "আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন" এর ভূমিকায় লিখেছেন ,  "কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কাব্যকেই আধুনিক কবিতা বলে গণ্য করা হয় ।‌ এই হিসেবে বুদ্ধদেব বসু একজন আধুনিক কবি ।

                  বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র-উত্তর কবি । রবীন্দ্র পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস তাঁর কবিতায় পরিলক্ষিত হয় । অথচ তিনি রবীন্দ্র- দ্রোহী নন  । আধুনিক পর্বে কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে কাব্য-সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু হলেন সব্যসাচী । কবিতা ,গল্প ,উপন্যাস, ভ্রমণ ও প্রবন্ধ যেমন তাঁর প্রতিভার আলোয় আলোকিত।  তেমনি কাব্যনাট্য রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তবে মূলতঃ তিনি কবি  ।

                বাল্যকাল থেকেই বুদ্ধদেব বসুর কবিতা শক্তির স্ফুরণ ঘটে । পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীর দাদা মশাই এর বাড়ী ছেড়ে যখন তিনি ১৯২৩ সালে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন তখন তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন ইংরেজিতে ।

      " Adieu, Adieu, Delony House dear,
        We leave you because the sea is near,
        And the sea will swallow you, we fear
        Adieu, Adieu .......    ........"

তবে তাঁর ইংরেজি কবিতা এটাই প্রথম এবং শেষ ।
কিশোর বয়স থেকেই নানা পত্র পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 
" মর্মবাণী" ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছাত্র । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে   রবীন্দ্র প্রভাব সুস্পষ্ট । এমনকি তাঁর কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের বন্ধুদের নিয়ে ১৯২৫ সালে প্রকাশ করেন  হাতে লেখা পত্রিকা "ক্ষণিকা" ।
এরপর ১৯২৭  আরেকটি হাতে লেখা পত্রিকা "প্রগতি" প্রকাশ করেন । পরবর্তীকালে "প্রগতি" মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হতে থাকে । বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এই পত্রিকার সম্পাদনের দায়িত্বে থাকেন আর এক বিশিষ্ট কবি ও অবাল্য বন্ধু অজিত দত্ত ।

                 বুদ্ধদেব বসুর "বন্দীর বন্দনা"(১৯৩০),  "কঙ্কাবতী"(১৯৩৭), " নতুন পাতা"(১৯৪০), "দময়ন্তী"(১৯৪৩), "দ্রৌপদীর শাড়ি"(১৯৪৮), "শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর"( ১৯৫৫), "যে আঁধার আলোর অধিক"(১৯৫৮), "মরচে-পড়া পেরেকের গান"(১৯৬৬)‌ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর দেখা যায়। তিনি মূলতঃ প্রেমের কবি । তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে কাম ও প্রেমের  দ্বন্দ্ব । বিশ্বসৃষ্টির মূলে রয়েছে দেহজ কাম । কিন্তু মানুষ শুধু কামের বশবর্তী হয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয় নি।  সে আবিষ্কার করেছে প্রেমকে।
"বন্দীর বন্দনা" থেকে একটি লাইন উদ্ধৃতি দিলাম :

" মোরে দিয়ে বিধাতার এই শুধু ছিল প্রয়োজন;
  স্রষ্টা শুধু এই চাহে, এ-বীভৎস ইন্দ্রিয়মিলন--
   নির্বিচারে প্রাণী সৃষ্টি করে থাকে যেমন পশুরা।"

                 "মানুষ" কবিতায় তিনি লেখেন :

"বিধাতারও চেয়ে বড়--- শক্তিমান, আরো সে মহান
নিজেরে নুতন করি' গড়িয়াছে আপন আগ্রহে।
এ জীর্ণ পাতার স্পর্শ নারীমাংস চেয়ে সুখকর,
মলাটে ধূলির গন্ধ- মুখ মদ্য তার তুল্য নয়,
গ্রন্থের অক্ষয় গ্রন্থি--- পরিপূর্ণ, প্রবল প্রণয়
এই প্রেমে সমাসীন স্বপ্নলব্ধ পরমসুন্দর ।"

             "কঙ্কাবতী" পূর্বরাগের কাব্য। ‌ সঙ্গমপূর্ব রতিই তাঁর অবলম্বন । "দ্রৌপদীর শাড়ি" , "শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর " কাব্যগ্রন্থে সঙ্গমউত্তর
রতিই কবিমানসে মুখ্যস্থান পেয়েছে । এরপর "মরচে পড়া পেরেকের গান"-- এ কবির উত্তরণ।
"আরোগ্যের তারিখ" কবিতায় কবি লেখেন :

       "থাকুন মঙ্গলে মাতা ও সন্তান,
       জমুক ধুলো পুঁথিপত্রে ।
       জগতে বিদ্বান আছেন ঢের;
        কিন্তু ভালোবাসা দৈব ।
        জগতের ঢের আছে পত্নী, পতি,
        কিন্তু প্রেমিকের অনটন ।"

"বন্দীর বন্দনা" কবিতায় আমরা দেখি, কামনা ছিল "অন্ধকার অমারাত্রিসম"। আর "মরচে পড়া পেরেকের গান" কাব্যগ্রন্থে পৌঁছে তিনি লিখলেন,
"মুক্ত বাসনার দাহ থেকে "।

                 বিশিষ্ট কাব্য সমালোচক কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য একদা প্রেমচেতনা সম্পর্কে তুলনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ,
"জীবনানন্দ কবি-সত্তায় প্রেমিক , বুদ্ধদেব প্রেমিক- সত্তায় কবি ,  আর প্রেমেন্দ্র মিত্র বিদ্রোহী-সত্তায় কবি ও প্রেমিক ।"
(Ref.  "আধুনিক কবিতার ভূমিকা": সঞ্জয় ভট্টাচার্য )
প্রেমের কবি বুদ্ধদেব বসুর প্রেমের আবেগ, উচ্ছাস ও সংরাগের প্রকাশ এমনভাবে উৎসারিত ও উচ্ছ্বসিত যে, তাঁর কবিতায় যেকোনো কাব্যরসিক আপ্লুত হয়ে পড়বেন । তাঁর প্রেম বায়বীয় নয়, রোমান্টিকও নয় , তাঁর প্রেম পার্থিব তাই শরীরী, দেহজ ।

            রচনাশৈলী দিক থেকেও বুদ্ধদেবের উত্তর উত্তর রূপান্তর ঘটেছে। " বন্দীর বন্দনা" রচিত হয়েছে মিশ্রবৃত্ত রীতির পয়ার ছন্দে। আবার "কঙ্কাবতী" তে কলাবৃত্ত রীতির সংগীতময় গীতধ্বনি ।

"ঘুমাও, ঘুমাও; আঁখি দুটি তব এসেছে তুলে,
                                           কঙ্কাবতী !
ঘুমাও, ঘুমাও ! রেখো না জানালা, রেখো না খুলে,
                                           কঙ্কাবতী !"

এরপর আবার রূপান্তর ঘটলো । "নতুন পাতা" কাব্যগ্রন্থে তিনি অবলম্বন করলেন গদ্যবন্ধের ।
তিনি তাঁর কবিতার প্রকরণ- কৌশল অর্থাৎ আঙ্গিক, মিল, ছন্দ, অবয়ব ইত্যাদির দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কাব্য সমালোচকদের মতে, কবিকৃতি ও কলাকৃতি উভয় দিক দিয়েই
"দময়ন্তী" শ্রেষ্ঠ।

              মূলতঃ কবি হলেও গদ্য রচনাটি ও তিনি তাঁর পরিশীলিত চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। ছোট গল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাসেও তিনি স্বচ্ছন্দ । রম্য রচনাতে তাঁর মননশীলতার পরিচয় পাই। গদ্য সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর ভাষার সৌজন্যে । তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে রচিত
"তপস্বী ও তরঙ্গিনী" (১৯৬৬), "কালসন্ধ্যা"(১৯৬৯),
"অনাম্নী অঙ্গনা "(১৯৬৯), "প্রথম পার্থ"(১৯৭০), "সংক্রান্তি"(১৯৭৩) - র মত কাব্যনাটক রচনা করেন ।

           তিনি দেশি-বিদেশি কবিদের কাব্য ও কবিতার অনুবাদ ও অনুলিখনও করেছিলেন । কালিদাস ( মেঘদুত), শংকরাচার্য ( আনন্দলহরী),
য়ুয়ান চন , বরিস পাস্টেরনাক , এজরা পাউন্ড , কামিংস , শার্ল বোদলেয়ার, রিলকে প্রভৃতি কবির কবিতা অনুবাদ করেন ।  বুদ্ধদেব বসু ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ‌। ফলে তাঁর রচনায় আমরা এজরা পাউন্ড, শার্ল বোদলেয়ার, লরেন্স, রিলকে , র‍্যাঁবো , এলিয়ট প্রমুখ কবির সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাই ।

               এক সময় তাঁর লেখায় অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল । এজন্য তাঁকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে ।

"তবু, ঈষদচ্ছ , এখনো ছায়ারহিত,
প'ড়ে রইল , এক ঝাড় এপ্রিলের বার্চগাছের মতো,
উষ্ণ, শূন্য, উন্মুক্ত যোনিদেশ ।"
( 'ভেনাসের জন্ম')

আর একটা উদ্ধৃতি দেই :

"দেখো, মোর বুকে দুটি পাকা ফল ভরেছে রসে---
বাসনার রসে সকল কালের সব পুরুষের । ....."
("কঙ্কাবতী" কাব্যগ্রন্থ থেকে)

                  বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ কবি । তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য তিনি যেমন নন্দিত হয়েছেন, আবার নিন্দিতও হয়েছেন।
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সমকালীন সাহিত্য কোন নিরালম্ব বায়ুভূক বস্তু নয় । অতীতের সঙ্গে রয়েছে তাঁর নাড়ির যোগ ও টান । তিনি চিরন্তন যৌবনের কবি ।।

_______________________________________
লেখক ---- অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া হুগলি।

_________________________________________
ঋণ স্বীকার :

১/  "আধুনিক কবি ও কবিতা" -- বুদ্ধদেব বসু ---- নন্দলাল মাইতি ।
২/ "আমার কালের কয়েকজন কবি" --- জগদীশ ভট্টাচার্য ।
৩/ বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা ---- দে'জ পাবলিশিং
_________________________________________

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

মারাঠি কবি নারায়ন সুরবে ( ১৯২৬-- ২০১০)/ Narayan Gangaram Surve

মারাঠি কবি নারায়ন সুরবে ( ১৯২৬-- ২০১০)

Narayan Gangaram Surve (15 October 1926 – 16 October 2010) was a Marathi poet from Maharashtra, India.

                 

   কলম ধরেছেন......সৌম্য ঘোষ




Narayan Gangaram Surve


          "একলা ত' আসিনি

          যুগটাও সাথে আছে ।

          তুফান থেকে সাবধান ।"


     ____  নারায়ন সুরবে । মারাঠি কাব্য সাহিত্যে আর পাঁচজন কবির চেয়ে একটু আলাদা । জন্ম, শৈশব, কৈশোর জর্জরিত হয়েছে অন্নচিন্তা করতে করতে। বিদ্যালয়ের লেখাপড়া মাত্র চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত । যা কিছু শিক্ষা, জীবন দর্শন সব আহোরণ করেছেন জীবন থেকে । জীবনে পাওয়া না পাওয়া

সুখ-দুঃখের স্বাদ থেকে । বেঁচে থাকার ধরন ও বৈচিত্র্য থেকে । মানুষের লোভ হিংসা ক্রোধ সাধ আহ্লাদ দুচোখ দিয়ে  দেখেছেন, মন দিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করেছেন। দেখেছেন দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন । তাই তাঁর কবিতায় কাব্য এবং জীবন পৃথক থাকেনি । অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে সম্পৃক্ত । জীবন মিশে গেছে কবিতায়, কবিতা মিশে গেছে জীবনে ।


         " এরা এবার জেগে উঠেছে

           বদলে দেবে পৃথিবীর রূপটাকেই ।"

কার্ল মার্কস, লেলিন এর আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুণ বয়স থেকে। সাধারনত: মারাঠি কবিতায় আমরা দেখতে পাই,  কেবল সুন্দর মধুর কল্পনা । আর তাও পরিবেশিত হয়ে থাকে কঠিন শব্দ আর দুর্বোধ্য ছন্দ প্রকরণের মাধ্যমে । যা অল্প শিক্ষিত ও সাধারণ বোধবুদ্ধির মানুষের পক্ষে বোধগম্য নয় ।

নারায়ণ সুরবে' সেই প্রথা ও বাধা ভেঙেছেন । তাঁর কবিতা বোঝার জন্য সংস্কৃত জানার প্রয়োজন নেই। নেই ছন্দজ্ঞান থাকার আবশ্যকতা । এই কারনে তাঁর কবিতা অন্য মাত্রা পায়, অন্য মূল্য পায় পাঠকসমাজে । তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেক কবির কাব্যকৃতি লিখনশৈলী ও রচনাকৌশল সেই যুগকে চিহ্নিত করে। তিনি বলেন, মানুষের কথাই আমি মানুষের জন্যই লিখি। 


    "এই বস্তিতেই একদা উদিত হবে নতুন সূর্য

      আমাকে এগিয়ে যেতে হবে ততদিন 

      দ্বারপ্রান্ত থেকে আসবে সোনারঙের রথ

      প্রিয়ে, আমার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে     

      ততদিন ..... "


সেই উদিত নতুন সূর্য আজও এলোনা । দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষগুলির স্বপ্ন আজও অধরা । পরিবর্তনবাদী মানুষগুলি চিরায়ত সমাজ ব্যবস্থায় লালিত শোষিত হতে হতে  ব্রাহ্মণ, সমাজপতি , ধনী ও শাসকদের প্রতি আজন্ম পালিত ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে একজোট হতে পারল না । সমাজে পরিবর্তন আর হলো না । উদিত হল না নতুন সূর্য ।

কখনো তাঁর কলম দুঃখবোধে জর্জরিত ------


       " আগামী দিনের সমস্ত দুঃখরাশি

         আমি ভুলে যাবো ভাবছি

         আজকের ব্যথাটুকু কোথা রাখি

         কেউ ত' বলে দেয় না ....."


তবুও কবির  দু'চোখে জীবনের আশা, নতুন ভোরের স্বপ্ন সবুজ কিশলয়ের মত কচিপাতা মেলে দেয় ------


  "হাতে ধরা পতাকা উড়বে

  হাঁসেরা উড়ে যাবে বাতাসের সঙ্গে

   যাত্রা শুরু হবে এবার

   শুরু হবে নব নব সৃষ্টির ।"



                মারাঠি সাহিত্যের সমালোচকদের বিচারে কবি নারায়ন সুরবে' নিজের স্বভাবগুণে, সৃষ্টি ও বৈচিত্রের গুনে এক সর্বজনস্বীকৃত স্বতন্ত্র জাতের কবিতা শিল্পী। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ -----

৭টি কবিতা সংকলন। প্রবন্ধ পুস্তক ৯টি । সম্পাদনা ৪টি ।  পুরস্কার পেয়েছেন ------  রাজ্য পুরস্কার (১৯৬৩ ও ১৯৬৭), সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কার (১৯৬৮) , নরসিং মেহেতা পুরস্কার (১৯৬৯), কবীর সম্মান পুরস্কার (১৯৬৯), জনস্থান পুরস্কার (২০০৫) প্রভৃতি  ।।

___________________________________________

    লেখক ... অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ । চুঁচুড়া। হুগলী

সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২০

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায় (Soumitra Chatterjee)

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়

                   বিপ্লব গোস্বামী


বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়কে যদিও আমরা একজন বিখ‍্যাত  চলচ্চিত্রাভিনেতা ও আবৃত্তিকার হিসাবে চিনি।তিনি কিন্তু এসবের পরও ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি।তাছাড়া তিনি ছিলেন একাধারে  লেখক,অনুবাদক,নাট‍্যকার ও নাট‍্যনির্দেশক।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়


               এই বিখ‍্যাত কবি-অভিনেতার  জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর গ্ৰামে।তাঁর পিতার নাম মোহিত কুমার চট্টোপাধ‍্যায় এবং মায়ের নাম আশালতা চট্টোপাধ‍্যায়।তাঁর পিতা পেশায় এক জন আইজীবী ছিলেন।তাই তাঁর বাবার কর্মসূত্রের জন‍্য  তাঁকে ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় কাটাতে হয়েছে।তাঁর প্রথাগত প্রাথমিক শিক্ষা শুরু নদীয়ার কৃষ্ণনগরে।তারপর হাওয়া জেলা স্কুল থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করেন।এরপর কলকাতা জেলা সিটি কলেজ থেকে আই.এস.সি।এরপর বাংলা সাহিত‍্য নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।শেষে পোস্ট গ্ৰ‍্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস এ পড়াশোনা করেন।

           কলেজে পড়ার সময় নাট‍্যভিনেতা শিশির কুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে পরিচয় হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়ের।ভাদুড়ীর অভিনয় সৌমিত্রকে গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত করে।তখন থেকেই অভিনয়কে জীবনের লক্ষ‍্য করে নেন সৌমিত্র।যদিও তাঁর কর্মজীবন অল ইণ্ডিয়া রেডিও-এর ঘোষক হিসাবে শুরু হয়।তিনি কিন্তু এর সাথে সাথে থিয়েটারে অভিনয় ও ছবিতে অডিশনও দিতেন।তাঁর চলচ্চিত্র জীবনে অভিনয় শুরু জগৎ বিখ‍্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত‍্যজিৎ রায়ের পরিচালিত অপুর সংসার ছবিতে অভিনয়ের মাধ‍্যমে।এরপর থেকে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।সুদীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্র জীবনে তিনশোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র।তিনি অভিনয় করেছেন সত‍্যজিৎ রায়ের পরিচালিত ২৭ টি চলচ্চিত্রের মধ‍্যে  ১৪ টি ছবিতে।সত‍্যজিৎ রায়ে পরিচালিত সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করে জন প্রিয়তা অর্জন করেন তিনি।তাঁর ভক্তদের কাছে পরিচিত হন ফেলুদা নামে।

      শুধু অভিনয় জগতে নয় সাহিত‍্য জগতেও সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়ের অবদান ছিল অতুলনীয়।আবৃত্তিকার হিসাবে তাঁর খ‍্যাতি বিশ্ব জোড়া।কবি বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ‍্যায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত‍্য জগতে প্রবেশ করেন।কাব‍্য জগতে পবেশ করার পর তাঁকে আর ফিরে তাকেতে হয়নি।মোট ১২-১৪ টি কাব‍্যগ্ৰন্থ রচনা করেছেন তিনি।কবিতা লিখে মন জয় করেছেন পাঠক হৃদয়ের।কবিতা লিখতে কোন দিন কোনও শর্ত রাখেননি তিনি।কোন শক্তির কাছে মাথা নত করেননি তিনি।সর্বদা তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে অনবদ‍্য শব্দের প্রকাশ।কলেজ জীবন থেকেই তাঁর কাব‍্য চর্চা শুরু।তাঁর প্রথম কাব‍্যগ্ৰন্থ 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে' প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে।২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ৮০০ পৃষ্ঠার 'কবিতা সমগ্ৰ'।তাঁর বিখ‍্যাত কিছু কাব‍্যগ্ৰন্থের নাম হলো জন্ম যায় জন্ম যাবে,হায় চিরজল,হে সায়ংকাল,মধ‍্যরাতের সংক্ষেত,স্বেচ্ছাবন্দি,আশার কুহক ইত‍্যাদি।এ ছাড়া তিনি এক্ষণ নামে একটি পত্রিকার প্রকাশনা ও সম্পাদনা করতেন।এ ছাড়া তিনি ছিলেন একজন বিখ‍্যাত আবৃত্তিকার।তাঁর কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।এ সবের পরও তিনি অবসর সময়ে ছবি আঁকতেন।

        অভিনয়ের জন‍্য তিনি পেয়েছেন দেশ বিদেশ থেকে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা।প্রথম জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯১ সালে‌। ২০০৪ সালে ভারত সরকার পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করে সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়কে।২০০৬ সালে পদক্ষেপ চলচ্চিত্রের জন‍্য লাভ করেন শ্রেষ্ট অভিনেতা বিভাগের পুরস্কার।২০১২ সালে সঙ্গীন নাট‍্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব পালকে পুরস্কার লাভ করেন তিনি।২০১৭ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক লিজিওন অফ অনার পুরস্কার লাভ করেন।তাছাড়া তিনি ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার লাভ করেন।

       অভিনেতা হলেও সাহিত‍্যের প্রতি তাঁর কতটা টান ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর নিজেরি কথায়।তিনি নিজে বলতেন,একজন অভিনেতার কল্পনা,অভিনয়,অনুভব,অভিজ্ঞতা সবই দাঁড়িয়ে থাকে ভাষা ও সাহিত‍্যের ভিতের উপর।কাজেই বাংলা ভাষার আশ্রয়ে অভিনয় করতে গেলে বাংলা ভাষা,শব্দ ও সাহিত‍্যের সঙ্গেও পরিচয়টা আবশ‍্যক।অন‍্যান‍্য সব শিল্পের মতোই অভিনয়েও মূল লক্ষ‍্য হলো জীবনের সত‍্য রূপকে ব‍্যক্ত করা।আর সেই লক্ষ‍্যের দিকে যাওয়ার জন‍্য অভিনেতা জীবনে যে অভিজ্ঞতার,কল্পনা ও অনুভবের প্রয়োজন হয় তা পাওয়া যায় সাহিত‍্য চর্চার মধ‍্য দিয়ে।কবি জয় গোস্বামীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন,অভিনয় করতে গেলে অভিনীত চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলাতেই মনোযোগ থাকে‌।আর নেজের মধ‍্যে সেই চরিত্রকে জাগিয়ে তুলে পরে দর্শকের দরবারে প্রকাশ।করার যে আনন্দ,তা চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ দিতে পারে কবিতা।লিখতে বসলে কোনও আড়াল খুঁজতে হয় না‌,বরং হৃদয় নিঙড়ে অন্তর আত্মাকে উজার করে দেওয়াই কবিতার দস্তর‌।

         ২০২০ সালের ১ অক্টোবর জ্বরে আক্রান্ত হন বিখ‍্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়।করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে ৫ অক্টোবর কোভিড-১৯ পজিটিভ রিজার্ট আসে।পরেদিন অর্থাৎ ৬ অক্টোবর তাঁকে বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। ১৪ অক্টোবর রিপর্টে করোনা নিগেটিভ আসলেও ২৪ অক্টোবর রাতে তাঁর শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে।শেষে ১৫ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ৮৫ বছর বয়সে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি মৃত‍্যু বরণ করেন।

     সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি অভিনেতা এবং বাংলা সাহিত‍্য জগতের একজন বিশিষ্ট কবি ও স্বনামধন‍্য আবৃত্তিকার।তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন‍্য তিনি সবার হৃদয় আসনে জায়গা করে আছেন আর অনন্ত কাল ধরে থাকবেনও।







রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০

নার্সিসাস বা নার্গিস ফুলের ইতিকথা

 

  নার্সিসাস বা নার্গিস ফুলের ইতিকথা
             অ পূ র্ব  হা ল দা র

         

অপূর্ব হালদার

ফুল -- যার সৌরভে, সুগন্ধে মন ভরে ওঠে। যার স্বল্প সময়ের আয়ুকালে স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী জেনেও মুগ্ধ হই আমরা। কমবেশি  ফুলকে আমরা সকলেই  খুব ভালোবাসি।  কিন্তু  কখনো আমরা ফুলের জন্মকথা নিয়ে খুব বেশি ভাবিত বা চিন্তিত হই না। তাহলে  চলুন আজ আমার খুব পছন্দের একটি ফুলের জন্মকথা নিয়ে আপনাদের একটু  গল্প বলি। বিভিন্ন ফুল ছড়িয়ে রয়েছে  আমাদের চারপাশে।  আর তাদের  জন্মকথা ঠিক তাদের মতোই সুন্দর, আকর্ষণীয়। এমনি একটি ফুলের কথা নিয়ে  আজ এসেছি। যার নাম একটু আগেই শিরোনামে জানতে পেরেছ,  নার্সিসাস বা নার্গিস ফুল। 

নার্গিস ফুল


এই ফুলের নাম আমরা বাংলার বুকে প্রথম পেয়েছিলাম   কাজী নজরুলের লেখায় কিংবা গানে।  ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম  কুমিল্লা তে আসলে এখানকার এক অপরূপ,অনিন্দ  সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েন, যার নাম ছিল সৈয়দা খাতুন কিন্তু  নিজে নাম বদল করে নাম রাখেন " নার্গিস। "  যার সাথে কাজী নজরুলের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু  সংসার না হয়েই রয়ে গেছে অসম প্রেমের কাহিনির করুণ পরিণতিতে! আর নার্সিসাসের মতোই না পাওয়া ভালোবাসায় পুড়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম।  " নার্গিস " শব্দটি উর্দু বা হিন্দি  শব্দ। যার বাংলা অর্থ  মনোযোগী, আকর্ষণ,  সক্রিয়তা।  এই ফুলের  আদি উৎস  নার্সিসাস,  যা ডেফোডিল জাতীয় ফুলের অন্তর্ভুক্ত। যার নামে এক করুণ পরিণতি লুকিয়ে রয়েছে!!
ফুলের জগতে ভিন্ন ভিন্ন  ফুল ছড়িয়ে থাকলেও এই ফুলের জন্মকথা  পর্বে সবার আগে উঠে আসে  কথিত থাকা আত্মপ্রেমে প্রাণ হারানো নার্সিসাসের কথা!
আমি এখানে সংক্ষেপিত ভাবে আলোচনা করছি সেই করুণ অভিশপ্ত কাহিনি, যার সাথে জড়িত এই নার্সিসাস ফুলের জন্মকথা লুকিয়ে রয়েছে।
নার্সিসাস  ছিলেন  নদীর দেবতা সিফিসাস ও পরী লিরিউপি 'র অতি সুদর্শন পুত্র।  নার্সিসাসের  মা তাঁর জন্মের পর  তাঁর ভবিষ্যত আয়ুষ্কাল নিয়ে  বারবার  টাইয়েসিয়াস এর কাছে যান।  টাইয়েসিয়াস এর ভবিষ্যতবাণী শুনে তাঁর মা লিরিউপি খুব ভয় পেয়ে যান।  ভবিষ্যতবাণী টা ছিল এমন -- " যতদিন এই ছেলে তার নিজ রূপ সম্পর্কে অবগত না হয় ততদিন পর্যন্ত  তার দীর্ঘ আয়ু নিয়ে  জীবন অতিবাহিত করবে। " এই কারণেই  তাঁকে নিয়ে তাঁর  মা চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং  আলাদা ভাবে একা রেখে মানুষ করেন। কিন্তু   বিপদ বাড়ে আরো। নার্সিসাসকে একা রেখে কারোর সাথে মিশতে না দিয়ে  বড়ো করার মধ্যে  নার্সিসাস খুবই আত্ম অহংকারী  হয়ে পড়েন।  এবং  পরবর্তীতে তাঁকে যেই প্রত্যক্ষ করে সেই তাঁর প্রেমে  পড়ে যায়, তাঁর অপূর্ব  সৌন্দর্যের কারণে।  এভাবে একদিন  করুণ পরিণতি নেমে এল নার্সিসাসের জীবনে।  অরণ্যের দেবী ইকো তাঁর প্রেমে পড়ে যায়। অপূর্ব মিষ্টি কন্ঠস্বরের অধিকারী  ছিলেন।   দুর্ভাগ্যবশতঃ  ইকো জিউসের স্ত্রী হেরার অভিশাপের কারণে  বোবা হয়ে যায়। অন্যের কথার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি  করতে পারতেন কিন্তু  কথা বলতে পারতেন না। ( এখান থেকেই ইকো/ ECHO শব্দের উৎপত্তি, যার বাংলা অর্থ  অন্যের কন্ঠস্বরকে প্রতিধ্বনিত করে বা অনুকরণ করে) ।
যাই হোক ,  বনে নার্সিসাসকে শিকাররত অবস্থায় প্রথম দেখেই   ইকো তাঁর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সে কথা বলতে  না পারায় ভালোবাসার কথা বলতে পারে না বা প্রকাশ করতে পারে না।  কিন্তু  এদিকে নার্সিসাস ইকোকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দেন এবং প্রত্যাখ্যান করেন। আর বলেন -- " মরে যাবো, তবুও কোনোদিন  তোমার হবো না। " ইকো কষ্ট পেয়ে  কাঁদতে থাকে আর এই দৃশ্য  প্রতিশোধের দেবী  নেমেসিস দেখতে পান এবং তখনই নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।  বনের ধারে একটি  হ্রদ বা পুকুরে জল পান করতে যান  নার্সিসাস। তখন নার্সিসাস জলের ওপর দেখে তার নিজ প্রতিবিম্ব। নিজের রূপ দেখে নিজেই  মুগ্ধ হয়ে ওঠে। আর বলে ওঠে -- " এত সুন্দর, এত সুন্দর! একেই তো আমি এতদিন খুঁজছিলাম। " কিন্তু  সে বুঝতে পারেনি যে ওই প্রতিবিম্ব তারই।এবং সাথে সাথেই  সে তার প্রেমে পড়ে যায়। নার্সিসাস নিচু হয়ে প্রতিবিম্ব'কে চুমো ( Kiss) খেতে  এল। ওই প্রতিবিম্বও তাকে একইভাবে চুমু খেতে এলো। 

এটাকে পারস্পরিক সম্মতি  মনে করে নার্সিসাস তাঁর প্রতিবিম্ব'কে জল থেকে টেনে তোলার জন্য  হাত বাড়ায় কিন্তু  জলে ঢেউ উঠতেই  সেই অপূর্ব সুন্দর প্রতিবিম্ব  চলে গেল।তার মনে হল জলদেবী চলে গেলেন।সে অস্থির হয়ে  গেলেন। কোথায় চলে গেল তাঁর ভালোবাসার মানুষটি??? 
যখন জল আবার স্থির হয়ে এল, তখন জল দেবীও ফিরে এলেন। নার্সিসাস মনে করলেন। এভাবেই নার্সিসাস জীবনে অসম প্রেমের কাহিনির করুণ পরিণতি গাঁথা থাকে। কেননা ইকো প্রার্থনা করেছিলেন  নেমেসিসের কাছে,  যে নার্সিসাস প্রেমে পড়লেও যেন ভালোবাসা না পায়। আমার মতোই বেদনায় থাকে, শোকাহত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত থাকে। নার্সিসাস এদিকে আবার জিজ্ঞেস করছে সেই জল দেবীকে ( নিজের প্রতিবিম্ব কে অন্যের ভাবা)  --  কেনো,  হে সুন্দর , কেনো তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকো, কেনো এড়িয়ে যাও আমাকে?  আমার চেহারা নিশ্চয় তোমাকে চলে যেতে বাধ্য করে  না।  পরীরা  আমাকে ভালোবাসে, পাওয়ার জন্য ব্যাকুল!! তোমাকেও তো আমার প্রতি বিরক্ত  দেখাচ্ছে না। যখন আমি আমার বাহু ( হাত)  কে বাড়িয়ে দিই, তুমিও তখন তাই করো।  তুমি আমাকে দেখো, হাসো, আমার মতো তুমিও মাথা নেড়ে সায় দাও। আবার হাত বাড়ালেন নার্সিসাস। আবার চলে গেলেন জল দেবী।  জল ছুঁলেই জল দেবী অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে যান আর হাত দিল না। যারা ভালোবাসতো তাকে তারা বারবার বলতে লাগলেন — হ্রদের কাছ থেকে  সরে আসতে! এভাবে নিজের  প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে জল না খেয়ে পুকুর পাড়ে বসেই থাকে। আর নার্সিসাস কিছু খেত না, জলও পান করত না, নড়াচড়া করত না।  চিরকালের মতো হ্রদের পাশে বসে থাকার ইচ্ছা দেখাল। ফলে এভাবে থাকার কারণে  ভুগতে ভুগতে  একসময় ইকোর মতো নার্সিসাস, তাঁর  ওই প্রতিবিম্ব 'র প্রেমে  পড়লেও তার ভালোবাসা না পাওয়ার শোকে শুকিয়ে যেতে  লাগলো,  নার্সিসাস হতাশায়, যন্ত্রণায় শোকাহত হয়ে পড়েন   এবং দিনের পর দিন না খাওয়ার কারণে   মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকেন!  এভাবেই  নার্সিসাসের মৃত্যু ঘটে।  আর কাদামাটিতে মিশে যায় নার্সিসাসের দেহ। সেখানকার সেই স্থানে ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি তৈরি করেন এক সবুজ গুল্ম।অসম্ভব সুন্দর আর তীব্র সুবাসিত সেই ফুল।  তার নামই নার্সিসাস। বাংলাতে যাকে আমরা  বলি " নার্গিস " ফুল।  নার্গিস শব্দটি " নার্জিস" থেকে এসছে, যা  একটি ফার্সি শব্দ।   আর এই নার্সিসাস শব্দটি আমার  কাছে  পরিচিত হলেও  শব্দটা বিদেশি শব্দ।  এই নার্সিসাস ফুলের জন্মকথা লুকিয়ে রয়েছে এভাবেই এক করুণ পরিণতি আত্ম প্রেমের গল্প!!


লেখক— অপূর্ব হালদার
( কলকাতা, বাংলা সাহিত্যে পাঠরত,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ) 


ঋণ স্বীকার - অন্তর্জাল
ছবি ঋণ স্বীকারের দাবি রাখে !!