বিশেষ ধারাবাহিক প্রবন্ধ :
-------------------------------------
প্রবন্ধ ----- কবি ও কবিতা
--------------------------------------
আত্মমগ্ন কবি কালীকৃষ্ণ গুহ ----- এক আলোকবর্তিকার সন্ধানে
সৌম্য ঘোষ
কবিও আলোর সন্ধান করেন। ‘অন্ধকার হতে উৎসারিত আলো’র পথে যাত্রার ইঙ্গিত তিনি দিয়ে যান। একজন কবির ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র প্রথম কবিতার প্রথম শব্দই যদি ‘রক্তাক্ত’ হয় তবে আর বলার অপেক্ষা রাখে না কোন জটিল অন্ধকারাচ্ছন্ন ভগ্ন মন্থনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়ে চলেছে।
তিনি কবি কালীকৃষ্ণ গুহ। উত্তর জীবনানন্দ কালের কবিদের মধ্যে অন্যতম।
জীবনানন্দ লিখেছিলেন- "মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো ; কবিতা লিখবার পথে কিছু দূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে। তবে সময়চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে।“ ( কবিতা প্রসঙ্গে’, ‘কবিতার কথা’, নিউ স্ক্রিপ্ট, মাঘ ১৪১৯, পৃ. ৩৭ )
একজন কবি এই নতুন মূল্যবোধের চেতনাতেই অগ্রসর হন। কেননা সময় সমাজের সঙ্গে মূল্যবোধ ও পারিপার্শ্বিক সমাজ জীবন পাল্টে যেতে বাধ্য।কবি যেমন সময়ের কথা লিপিবদ্ধ করবেন তেমনি আপন মনগহনে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করবেন। কালীকৃষ্ণ গুহের প্রকৃতির স্বপ্নিল নিকেতনে এক অনলস বিচারণের স্বাভাবিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দের সার্থক উত্তরাসূরী হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও কালীকৃষ্ণ গুহকে প্রতিষ্ঠা করা বোধহয় শক্ত নয়। একজন দক্ষ কবির প্রকৃত কাজ সদা অলিখিত পাতা ভরে ফেলা, লিখিত পাতায় লেখা নয়। এই লিখিত পাতা বলতে আমি বলতে চেয়েছি অনুকরণ । তবে প্রভাবিত হওয়া স্বাভাবিক। চেতনে অবচেতনে কাব্যপাঠের মধ্য দিয়ে যে কবিসত্তা গড়ে ওঠে সেখানে অনিবার্য ভাবে প্রিয় কবির শব্দবন্ধন, চিত্রকল্প উঁকি দেয়। কবিকে সচেতন ভাবেই সেই চেনাপথ অতিক্রম করে অচেনা, অজানা গলিপথ থেকে রাজপথে যেতে হয়। আর এই যাওয়ার পথ খুব সহজ নয়। জীবনানন্দ দাশকে সামনে রেখেই কালীকৃষ্ণ গুহ কাব্যক্ষেত্রে নেমেছেন, বেশ কিছুক্ষেত্রে সফল ভাবে নিজস্ব অতিক্রম করেছেন- কাব্যপাঠে এমনই অভিজ্ঞতা জানান দেয়।
কবিতায় তিনি কী লিখতে চান, দেখে নিতে পারি নিজস্ব বক্তব্য থেকেই --
-“ অজস্র স্মৃতির আলোড়ন ও নির্জ্ঞান নিয়ে অভিজ্ঞতার পুরাণ ও অন্তর্নিহিত ভাঙন নিয়ে ক্ষতবিক্ষত অবচেতন নিয়ে নারী ও শূনতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর কম্পন নিয়ে নিরন্তর নাক্ষত্রিক উৎসবের কিছু অন্ধকার নিয়ে যে জীবন কাটিয়ে এসেছি তা থেকে সঞ্চারিত কিছু বেদনাবোধ আর কিছু নীরবতার প্রতিবেদন ছাড়া অধিক কিছু পাবার নেই এইসব লেখায়।“ ( ভূমিকা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ, পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ- ডিসেম্বর ২০১৩ )
এই ‘বেদনাবোধ’ ও ‘নীরবতার প্রতিবেদন’ ছাড়াও তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রকৃতিচেতনা। লাভ লোকসানের হিসেব নয় তিনি কবিতায় সত্য আবিষ্কারে মত্ত। জনপ্রিয় হতে চান নি, নিমগ্ন থেকেছেন আত্মপ্রেচষ্টায়, সেখানে বিচারণ এক সত্য- “ আমরা কবিতা লিখি, আমাদের ক্ষতি কিছু হয় না”( ‘ঝড়েশ্বর বাখরা’, ঐ , পৃ. ৩২)। কবিতাই কবির পরিচয়ের শ্রেষ্ঠ ধ্রুবক।
লেখা শুরু করেছেন ছয়ের দশকে। ইতিমধ্যে বহুকাব্য প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল – ‘ রক্তাক্ত বেদীর পাশে’( ১৯৬৭), ‘ নির্বাসন নাম ডাকনাম’ ( ১৯৭২ ), ‘ হস্টেল থেকে লেখা কবিতা’ ( ১৯৮৪ ), ‘ হে নিদ্রাহীন’ ( ১৯৮৮), ‘ পিতামহ, খোয়াইয়ে এসেছি’ ( ১৯৯০), ‘ তোমার প্রবাহ, চৈতমাস’ ( ১৯৯১), ‘ ক্লান্তির ভিতরে এই শেষ’( ১৯৯৬), ‘ স্মৃতিহীনতার মধ্যে নিস্তব্ধ পুরাণ’ ( ১৯৯৯), ও ‘ বৃষ্টির ভ্রমণ’ ( ২০১২ )। কতগুলি পর্যায় ক্রমে আমরা তাঁর কাব্যপাঠে অগ্রসর হব।
কবি কালীকৃষ্ণ গুহ প্রকৃতির অতলন্ত পরিবেশে মিশে থাকতে ভালোবাসেন। চেনা জানা প্রকৃতির নিবিড় গহীন গাঙ থেকেই তাঁর কাব্যস্বর উচ্চারিত হয়। এক নস্টালজিক মন মৃদু স্পর্শে ভাববিশ্বে রূপায়িত হয়। সেখানে তিনি আর কোন আড়াল খোঁজেন না। অবচেতন বিশ্বে নিজস্ব স্বর থেকে বহুদূরে প্রসারিত হয়ে যায়। প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব স্বদেশ থাকে। তাঁর কবিতায় একটা জার্নি আছে, সেখানে প্রাপ্তি বলে কিছু নেই শুধুই অনুভূতির এক গদ্যসত্তা বিরজামান-
“ রাত্রির ভিতর দিয়ে হেঁটে গেছে মানুষ, এইতো তার ভাষা –
তার অভিজ্ঞতা এই পাথরের মধ্যে আছে,
মৃত্যু এবং জন্মদিন আছে, প্রিয়তমা নারীর মুখ আছে, রাগিণী আছে।
এইখানে এসে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে, সময়ের অস্পষ্ট শিলালিপি
পড়ে দেখতে ইচ্ছে করে, বলতে ইচ্ছে করে :”
( ‘পর্যটন’, ঐ, পৃ. ২১ )
স্বপ্ন, বিচ্ছেদ, বিশ্বাস ও বিশ্বাসভঙ্গ সমস্তকেই তিনি প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। আকাঙ্ক্ষিত মন নিয়ে অন্ধকারে বিরজামানসত্তা এগিয়ে আসে আলোর পথে। কখনও বা শুধু স্মৃতি নির্ভর জীবনসমুদ্র মন্থনে অগ্রসর। তাঁর স্মৃতি রোমন্থনে একাকিত্ব আছে কিন্তু একাকিত্ব থেকে বাঁচতে প্রকৃতিই বড় সহচার্য হয়ে উঠেছে।
নগর কলকাতার নিয়মতান্ত্রিক জীবনের ক্লেদ গ্লানিই হয়ে উঠেছে কবিতার সত্য। কিন্তু এই ক্লান্তবিধুর অবস্থা থেকে কবি পরিত্রাণ চেয়েছেন। নৈঃশব্দের অন্তঃলোকে বিচরণ করতে চেয়েছেন-
“ আজ সন্ধায় আবার তোমার কাছে কেন ফিরে এলাম, কার্তিকের মাঠ ?
গত দশবছর ধরে অনেক তর্কের পর তোমার এইসব পুরোনো
গাছগুলির কাছে কেন ফিরে এলাম আবার ?”
( ‘কার্তিকের মাঠ’, ঐ, পৃ. ৩০ )
কবি তো জীবনের জয়গানই গেয়ে চলেন। জীবনের ত্রিবিধ স্বরান্তের ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেন। কবিতার শুরুই হয়েছিল বাল্মীকির যে শ্লোক দিয়ে সেখানে ছিল প্রকৃতির দৃশ্য। সে কাল থেকে একাল অবধি বহু কবি বৃক্ষকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তারপরও একজন কবি কেন বৃক্ষকে নিয়ে কবিতে লিখবেন ? আসলে কবি তো কবিতায় নিজের অনুভূতিকেই ব্যক্ত করতে চান। হৃদয় মন্থনজাত সে অনুভূতি অবশ্যই পৃথক। তাই বহু কবিতার পরেও কবি ‘বৃক্ষ’ কবিতায় ব্যক্ত করেন-
“ তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, বৃক্ষ।
বলা হয়েছে, তোমার পবিত্রতার ভিতর থেকে নিয়তি মাথা তোলে, তার
পুরোনো মুখ তোলে।
অজস্র কবির কাছে ঋণ রয়েছে তোমার।
বৃক্ষ, আজ তুমি আমার ঘুমের মধ্যে শান্ত ডালপালা ছড়িয়ে দাও
যথাযথ নির্জনতা দাও
( ‘বৃক্ষ’, ঐ, পৃ. ৩২ )
জীবনানন্দ হেমন্ত সচেতন, কালীকৃষ্ণ গুহের কবিতায় শরৎকালের প্রাধান্য। তবে এখানেও রয়েছে ক্লান্তি ও অন্ধকারের ইঙ্গিত। তবে এই ক্লান্ত জীবনের মধ্যেই রয়েছে নতুনের হাতছানি। পরিশীলিত ভূগোলের মধ্যেই কবি সুখের সন্ধান করেছেন। সে অনুসন্ধান এসেছে নবজাতকের আগমনের মধ্য দিয়ে। কখনও আবার চিত্র আঁকেন। সে চিত্রে মিশে থাকে ক্ষয়িষ্ণু সময় ও মূল্যবোধের ধূসর পাণ্ডুলিপি। আর স্বগত আত্মকথনে উচ্চারিত হয় –
“ নিঃসঙ্গ দিন যায়। দীর্ঘ দুপুর
গ্রীষ্ম
ধুলো উড়িয়ে আনে।
শিশুবর্ষের এক একটি দিন যায় – নিঃসঙ্গ ধুলো –ওড়া দিন
শুধু মাঝে মাঝে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বোদলেয়রের মুখ,
র্যাঁবোর মুখ, আর “
( ‘গ্রীষ্মের দুপুর’, ঐ, পৃ. ৩৭ )
কবিতার সত্যে, ব্যক্তি অনুভূতির সত্যে, আলোর সন্ধানেই আনন্দধারা বর্ষিত হয়। সমস্ত মুছে দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন –
“ বৃষ্টি আনে প্রতিশ্রুতি, খণ্ড অন্ধকার
বৃষ্টি আনে ভয় আর দৃশ্যের আড়াল আর বিলুপ্ত শৈশব
বৃষ্টি আনে রজস্বলা রমণীর গান, পরচুলা
বৃষ্টি আনে স্বগতোক্তিময় এক উন্মাদ রচনা
বৃষ্টি আনে অন্ধত্বের পাশাপাশি বেড়ে ওঠা দেবদারুগাছ”
( ‘তোমার প্রবাহ, চৈত্রমাস’, ঐ, পৃ. ৬৩ )
কালীকৃষ্ণ গুহ লেখেন –“ অদ্ভুত এক ঝিঁঝির ডাক নির্ধারিত করে দিচ্ছে এই সময়কে।“ ( ‘এই গ্রহ’, ঐ, পৃ. ৭২ )
আনন্দসত্তা পূর্ণ বিকশিত হয়েছে প্রকৃতির মধ্যেই –
“ জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছে মাঠ গাছপালা বাড়িঘর সঙ্ঘ অতিথিশালা
জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছে দীর্ঘ সব শালবন
জ্যোৎস্নায় ভরে গিয়েছে ব্রিজ মূর্তি অগণিত ধর্ম- পাতাকা
জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমাদের পাপের ভিতরে
জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমাদের পাপপুণ্যের অতীত সব জিজ্ঞাসায়
জ্যোৎস্না এসে পড়েছে আমাদের স্মৃতিতে, কামনাবাসনায়”
( ‘ সুদূর অতীতকালের মধ্য থেকে কাক ডাকছে’, ঐ, পৃ. ১২৭ )
কবি সেখানে মিশে যেতে চান-
“ যখন কিছু ভেবে- ওঠার আগেই বৃষ্টিতে ভিজে যাও তুমি
যখন তোমার অতীতকালও বৃষ্টিতে ভিজে যায়
যখন মল্লার গাওয়া হয় নিরবধিকালের নৈঃশব্দ্যকে বোঝানোর জন্য
তখনো আঘাত আসে।“
( ‘আঘাত’, ঐ, পৃ. ১৩৩ )
কাব্যযাত্রায় তিনি জীবনানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হলেও অচিরেই নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়েছেন। ফলে শব্দসজ্জা, চিত্রকল্প ও উপস্থাপন রীতিতে এসেছে অভিনবত্ব- এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, এখানেই তিনি কালজয়ী শিল্পী।
__________________________________________
লেখক :---- অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ । চুঁচুড়া। হুগলী।
0 comments: