রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০

নার্সিসাস বা নার্গিস ফুলের ইতিকথা

 

  নার্সিসাস বা নার্গিস ফুলের ইতিকথা
             অ পূ র্ব  হা ল দা র

         

অপূর্ব হালদার

ফুল -- যার সৌরভে, সুগন্ধে মন ভরে ওঠে। যার স্বল্প সময়ের আয়ুকালে স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী জেনেও মুগ্ধ হই আমরা। কমবেশি  ফুলকে আমরা সকলেই  খুব ভালোবাসি।  কিন্তু  কখনো আমরা ফুলের জন্মকথা নিয়ে খুব বেশি ভাবিত বা চিন্তিত হই না। তাহলে  চলুন আজ আমার খুব পছন্দের একটি ফুলের জন্মকথা নিয়ে আপনাদের একটু  গল্প বলি। বিভিন্ন ফুল ছড়িয়ে রয়েছে  আমাদের চারপাশে।  আর তাদের  জন্মকথা ঠিক তাদের মতোই সুন্দর, আকর্ষণীয়। এমনি একটি ফুলের কথা নিয়ে  আজ এসেছি। যার নাম একটু আগেই শিরোনামে জানতে পেরেছ,  নার্সিসাস বা নার্গিস ফুল। 

নার্গিস ফুল


এই ফুলের নাম আমরা বাংলার বুকে প্রথম পেয়েছিলাম   কাজী নজরুলের লেখায় কিংবা গানে।  ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলাম  কুমিল্লা তে আসলে এখানকার এক অপরূপ,অনিন্দ  সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েন, যার নাম ছিল সৈয়দা খাতুন কিন্তু  নিজে নাম বদল করে নাম রাখেন " নার্গিস। "  যার সাথে কাজী নজরুলের বিয়ে হয়েছিল কিন্তু  সংসার না হয়েই রয়ে গেছে অসম প্রেমের কাহিনির করুণ পরিণতিতে! আর নার্সিসাসের মতোই না পাওয়া ভালোবাসায় পুড়েছিল কাজী নজরুল ইসলাম।  " নার্গিস " শব্দটি উর্দু বা হিন্দি  শব্দ। যার বাংলা অর্থ  মনোযোগী, আকর্ষণ,  সক্রিয়তা।  এই ফুলের  আদি উৎস  নার্সিসাস,  যা ডেফোডিল জাতীয় ফুলের অন্তর্ভুক্ত। যার নামে এক করুণ পরিণতি লুকিয়ে রয়েছে!!
ফুলের জগতে ভিন্ন ভিন্ন  ফুল ছড়িয়ে থাকলেও এই ফুলের জন্মকথা  পর্বে সবার আগে উঠে আসে  কথিত থাকা আত্মপ্রেমে প্রাণ হারানো নার্সিসাসের কথা!
আমি এখানে সংক্ষেপিত ভাবে আলোচনা করছি সেই করুণ অভিশপ্ত কাহিনি, যার সাথে জড়িত এই নার্সিসাস ফুলের জন্মকথা লুকিয়ে রয়েছে।
নার্সিসাস  ছিলেন  নদীর দেবতা সিফিসাস ও পরী লিরিউপি 'র অতি সুদর্শন পুত্র।  নার্সিসাসের  মা তাঁর জন্মের পর  তাঁর ভবিষ্যত আয়ুষ্কাল নিয়ে  বারবার  টাইয়েসিয়াস এর কাছে যান।  টাইয়েসিয়াস এর ভবিষ্যতবাণী শুনে তাঁর মা লিরিউপি খুব ভয় পেয়ে যান।  ভবিষ্যতবাণী টা ছিল এমন -- " যতদিন এই ছেলে তার নিজ রূপ সম্পর্কে অবগত না হয় ততদিন পর্যন্ত  তার দীর্ঘ আয়ু নিয়ে  জীবন অতিবাহিত করবে। " এই কারণেই  তাঁকে নিয়ে তাঁর  মা চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং  আলাদা ভাবে একা রেখে মানুষ করেন। কিন্তু   বিপদ বাড়ে আরো। নার্সিসাসকে একা রেখে কারোর সাথে মিশতে না দিয়ে  বড়ো করার মধ্যে  নার্সিসাস খুবই আত্ম অহংকারী  হয়ে পড়েন।  এবং  পরবর্তীতে তাঁকে যেই প্রত্যক্ষ করে সেই তাঁর প্রেমে  পড়ে যায়, তাঁর অপূর্ব  সৌন্দর্যের কারণে।  এভাবে একদিন  করুণ পরিণতি নেমে এল নার্সিসাসের জীবনে।  অরণ্যের দেবী ইকো তাঁর প্রেমে পড়ে যায়। অপূর্ব মিষ্টি কন্ঠস্বরের অধিকারী  ছিলেন।   দুর্ভাগ্যবশতঃ  ইকো জিউসের স্ত্রী হেরার অভিশাপের কারণে  বোবা হয়ে যায়। অন্যের কথার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি  করতে পারতেন কিন্তু  কথা বলতে পারতেন না। ( এখান থেকেই ইকো/ ECHO শব্দের উৎপত্তি, যার বাংলা অর্থ  অন্যের কন্ঠস্বরকে প্রতিধ্বনিত করে বা অনুকরণ করে) ।
যাই হোক ,  বনে নার্সিসাসকে শিকাররত অবস্থায় প্রথম দেখেই   ইকো তাঁর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সে কথা বলতে  না পারায় ভালোবাসার কথা বলতে পারে না বা প্রকাশ করতে পারে না।  কিন্তু  এদিকে নার্সিসাস ইকোকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দেন এবং প্রত্যাখ্যান করেন। আর বলেন -- " মরে যাবো, তবুও কোনোদিন  তোমার হবো না। " ইকো কষ্ট পেয়ে  কাঁদতে থাকে আর এই দৃশ্য  প্রতিশোধের দেবী  নেমেসিস দেখতে পান এবং তখনই নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।  বনের ধারে একটি  হ্রদ বা পুকুরে জল পান করতে যান  নার্সিসাস। তখন নার্সিসাস জলের ওপর দেখে তার নিজ প্রতিবিম্ব। নিজের রূপ দেখে নিজেই  মুগ্ধ হয়ে ওঠে। আর বলে ওঠে -- " এত সুন্দর, এত সুন্দর! একেই তো আমি এতদিন খুঁজছিলাম। " কিন্তু  সে বুঝতে পারেনি যে ওই প্রতিবিম্ব তারই।এবং সাথে সাথেই  সে তার প্রেমে পড়ে যায়। নার্সিসাস নিচু হয়ে প্রতিবিম্ব'কে চুমো ( Kiss) খেতে  এল। ওই প্রতিবিম্বও তাকে একইভাবে চুমু খেতে এলো। 

এটাকে পারস্পরিক সম্মতি  মনে করে নার্সিসাস তাঁর প্রতিবিম্ব'কে জল থেকে টেনে তোলার জন্য  হাত বাড়ায় কিন্তু  জলে ঢেউ উঠতেই  সেই অপূর্ব সুন্দর প্রতিবিম্ব  চলে গেল।তার মনে হল জলদেবী চলে গেলেন।সে অস্থির হয়ে  গেলেন। কোথায় চলে গেল তাঁর ভালোবাসার মানুষটি??? 
যখন জল আবার স্থির হয়ে এল, তখন জল দেবীও ফিরে এলেন। নার্সিসাস মনে করলেন। এভাবেই নার্সিসাস জীবনে অসম প্রেমের কাহিনির করুণ পরিণতি গাঁথা থাকে। কেননা ইকো প্রার্থনা করেছিলেন  নেমেসিসের কাছে,  যে নার্সিসাস প্রেমে পড়লেও যেন ভালোবাসা না পায়। আমার মতোই বেদনায় থাকে, শোকাহত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত থাকে। নার্সিসাস এদিকে আবার জিজ্ঞেস করছে সেই জল দেবীকে ( নিজের প্রতিবিম্ব কে অন্যের ভাবা)  --  কেনো,  হে সুন্দর , কেনো তুমি আমার কাছ থেকে দূরে থাকো, কেনো এড়িয়ে যাও আমাকে?  আমার চেহারা নিশ্চয় তোমাকে চলে যেতে বাধ্য করে  না।  পরীরা  আমাকে ভালোবাসে, পাওয়ার জন্য ব্যাকুল!! তোমাকেও তো আমার প্রতি বিরক্ত  দেখাচ্ছে না। যখন আমি আমার বাহু ( হাত)  কে বাড়িয়ে দিই, তুমিও তখন তাই করো।  তুমি আমাকে দেখো, হাসো, আমার মতো তুমিও মাথা নেড়ে সায় দাও। আবার হাত বাড়ালেন নার্সিসাস। আবার চলে গেলেন জল দেবী।  জল ছুঁলেই জল দেবী অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে যান আর হাত দিল না। যারা ভালোবাসতো তাকে তারা বারবার বলতে লাগলেন — হ্রদের কাছ থেকে  সরে আসতে! এভাবে নিজের  প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে জল না খেয়ে পুকুর পাড়ে বসেই থাকে। আর নার্সিসাস কিছু খেত না, জলও পান করত না, নড়াচড়া করত না।  চিরকালের মতো হ্রদের পাশে বসে থাকার ইচ্ছা দেখাল। ফলে এভাবে থাকার কারণে  ভুগতে ভুগতে  একসময় ইকোর মতো নার্সিসাস, তাঁর  ওই প্রতিবিম্ব 'র প্রেমে  পড়লেও তার ভালোবাসা না পাওয়ার শোকে শুকিয়ে যেতে  লাগলো,  নার্সিসাস হতাশায়, যন্ত্রণায় শোকাহত হয়ে পড়েন   এবং দিনের পর দিন না খাওয়ার কারণে   মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকেন!  এভাবেই  নার্সিসাসের মৃত্যু ঘটে।  আর কাদামাটিতে মিশে যায় নার্সিসাসের দেহ। সেখানকার সেই স্থানে ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি তৈরি করেন এক সবুজ গুল্ম।অসম্ভব সুন্দর আর তীব্র সুবাসিত সেই ফুল।  তার নামই নার্সিসাস। বাংলাতে যাকে আমরা  বলি " নার্গিস " ফুল।  নার্গিস শব্দটি " নার্জিস" থেকে এসছে, যা  একটি ফার্সি শব্দ।   আর এই নার্সিসাস শব্দটি আমার  কাছে  পরিচিত হলেও  শব্দটা বিদেশি শব্দ।  এই নার্সিসাস ফুলের জন্মকথা লুকিয়ে রয়েছে এভাবেই এক করুণ পরিণতি আত্ম প্রেমের গল্প!!


লেখক— অপূর্ব হালদার
( কলকাতা, বাংলা সাহিত্যে পাঠরত,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ) 


ঋণ স্বীকার - অন্তর্জাল
ছবি ঋণ স্বীকারের দাবি রাখে !!




1 টি মন্তব্য:

  1. অনেক ধন্যবাদ।
    সম্পাদক মহাশয় কে আমার তরফ থেকে অনেক শুভেচ্ছা ও প্রণাম জ্ঞাপন করি।

    উত্তরমুছুন