মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০

প্রবন্ধ কবি ও কবিতা বুদ্ধদেব বসু প্রেমিক-সত্তায় কবি


        প্রবন্ধ  কবি ও কবিতা

  বুদ্ধদেব বসু ------  প্রেমিক-সত্তায় কবি
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''""""""""""""
                  সৌম্য ঘোষ
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""

              উত্তর-রৈবিক পর্বের আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনে একটি স্মরণীয় নাম,  বুদ্ধদেব বসু । "কল্লোল যুগের" অন্যতম তরুণতম প্রতিনিধি হলেন বুদ্ধদেব । আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর "আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন" এর ভূমিকায় লিখেছেন ,  "কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কাব্যকেই আধুনিক কবিতা বলে গণ্য করা হয় ।‌ এই হিসেবে বুদ্ধদেব বসু একজন আধুনিক কবি ।

                  বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র-উত্তর কবি । রবীন্দ্র পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস তাঁর কবিতায় পরিলক্ষিত হয় । অথচ তিনি রবীন্দ্র- দ্রোহী নন  । আধুনিক পর্বে কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে কাব্য-সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু হলেন সব্যসাচী । কবিতা ,গল্প ,উপন্যাস, ভ্রমণ ও প্রবন্ধ যেমন তাঁর প্রতিভার আলোয় আলোকিত।  তেমনি কাব্যনাট্য রচনাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তবে মূলতঃ তিনি কবি  ।

                বাল্যকাল থেকেই বুদ্ধদেব বসুর কবিতা শক্তির স্ফুরণ ঘটে । পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীর দাদা মশাই এর বাড়ী ছেড়ে যখন তিনি ১৯২৩ সালে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন তখন তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন ইংরেজিতে ।

      " Adieu, Adieu, Delony House dear,
        We leave you because the sea is near,
        And the sea will swallow you, we fear
        Adieu, Adieu .......    ........"

তবে তাঁর ইংরেজি কবিতা এটাই প্রথম এবং শেষ ।
কিশোর বয়স থেকেই নানা পত্র পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 
" মর্মবাণী" ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছাত্র । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে   রবীন্দ্র প্রভাব সুস্পষ্ট । এমনকি তাঁর কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়। ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র থাকাকালীন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের বন্ধুদের নিয়ে ১৯২৫ সালে প্রকাশ করেন  হাতে লেখা পত্রিকা "ক্ষণিকা" ।
এরপর ১৯২৭  আরেকটি হাতে লেখা পত্রিকা "প্রগতি" প্রকাশ করেন । পরবর্তীকালে "প্রগতি" মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হতে থাকে । বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে এই পত্রিকার সম্পাদনের দায়িত্বে থাকেন আর এক বিশিষ্ট কবি ও অবাল্য বন্ধু অজিত দত্ত ।

                 বুদ্ধদেব বসুর "বন্দীর বন্দনা"(১৯৩০),  "কঙ্কাবতী"(১৯৩৭), " নতুন পাতা"(১৯৪০), "দময়ন্তী"(১৯৪৩), "দ্রৌপদীর শাড়ি"(১৯৪৮), "শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর"( ১৯৫৫), "যে আঁধার আলোর অধিক"(১৯৫৮), "মরচে-পড়া পেরেকের গান"(১৯৬৬)‌ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর দেখা যায়। তিনি মূলতঃ প্রেমের কবি । তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে কাম ও প্রেমের  দ্বন্দ্ব । বিশ্বসৃষ্টির মূলে রয়েছে দেহজ কাম । কিন্তু মানুষ শুধু কামের বশবর্তী হয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয় নি।  সে আবিষ্কার করেছে প্রেমকে।
"বন্দীর বন্দনা" থেকে একটি লাইন উদ্ধৃতি দিলাম :

" মোরে দিয়ে বিধাতার এই শুধু ছিল প্রয়োজন;
  স্রষ্টা শুধু এই চাহে, এ-বীভৎস ইন্দ্রিয়মিলন--
   নির্বিচারে প্রাণী সৃষ্টি করে থাকে যেমন পশুরা।"

                 "মানুষ" কবিতায় তিনি লেখেন :

"বিধাতারও চেয়ে বড়--- শক্তিমান, আরো সে মহান
নিজেরে নুতন করি' গড়িয়াছে আপন আগ্রহে।
এ জীর্ণ পাতার স্পর্শ নারীমাংস চেয়ে সুখকর,
মলাটে ধূলির গন্ধ- মুখ মদ্য তার তুল্য নয়,
গ্রন্থের অক্ষয় গ্রন্থি--- পরিপূর্ণ, প্রবল প্রণয়
এই প্রেমে সমাসীন স্বপ্নলব্ধ পরমসুন্দর ।"

             "কঙ্কাবতী" পূর্বরাগের কাব্য। ‌ সঙ্গমপূর্ব রতিই তাঁর অবলম্বন । "দ্রৌপদীর শাড়ি" , "শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর " কাব্যগ্রন্থে সঙ্গমউত্তর
রতিই কবিমানসে মুখ্যস্থান পেয়েছে । এরপর "মরচে পড়া পেরেকের গান"-- এ কবির উত্তরণ।
"আরোগ্যের তারিখ" কবিতায় কবি লেখেন :

       "থাকুন মঙ্গলে মাতা ও সন্তান,
       জমুক ধুলো পুঁথিপত্রে ।
       জগতে বিদ্বান আছেন ঢের;
        কিন্তু ভালোবাসা দৈব ।
        জগতের ঢের আছে পত্নী, পতি,
        কিন্তু প্রেমিকের অনটন ।"

"বন্দীর বন্দনা" কবিতায় আমরা দেখি, কামনা ছিল "অন্ধকার অমারাত্রিসম"। আর "মরচে পড়া পেরেকের গান" কাব্যগ্রন্থে পৌঁছে তিনি লিখলেন,
"মুক্ত বাসনার দাহ থেকে "।

                 বিশিষ্ট কাব্য সমালোচক কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য একদা প্রেমচেতনা সম্পর্কে তুলনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ,
"জীবনানন্দ কবি-সত্তায় প্রেমিক , বুদ্ধদেব প্রেমিক- সত্তায় কবি ,  আর প্রেমেন্দ্র মিত্র বিদ্রোহী-সত্তায় কবি ও প্রেমিক ।"
(Ref.  "আধুনিক কবিতার ভূমিকা": সঞ্জয় ভট্টাচার্য )
প্রেমের কবি বুদ্ধদেব বসুর প্রেমের আবেগ, উচ্ছাস ও সংরাগের প্রকাশ এমনভাবে উৎসারিত ও উচ্ছ্বসিত যে, তাঁর কবিতায় যেকোনো কাব্যরসিক আপ্লুত হয়ে পড়বেন । তাঁর প্রেম বায়বীয় নয়, রোমান্টিকও নয় , তাঁর প্রেম পার্থিব তাই শরীরী, দেহজ ।

            রচনাশৈলী দিক থেকেও বুদ্ধদেবের উত্তর উত্তর রূপান্তর ঘটেছে। " বন্দীর বন্দনা" রচিত হয়েছে মিশ্রবৃত্ত রীতির পয়ার ছন্দে। আবার "কঙ্কাবতী" তে কলাবৃত্ত রীতির সংগীতময় গীতধ্বনি ।

"ঘুমাও, ঘুমাও; আঁখি দুটি তব এসেছে তুলে,
                                           কঙ্কাবতী !
ঘুমাও, ঘুমাও ! রেখো না জানালা, রেখো না খুলে,
                                           কঙ্কাবতী !"

এরপর আবার রূপান্তর ঘটলো । "নতুন পাতা" কাব্যগ্রন্থে তিনি অবলম্বন করলেন গদ্যবন্ধের ।
তিনি তাঁর কবিতার প্রকরণ- কৌশল অর্থাৎ আঙ্গিক, মিল, ছন্দ, অবয়ব ইত্যাদির দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কাব্য সমালোচকদের মতে, কবিকৃতি ও কলাকৃতি উভয় দিক দিয়েই
"দময়ন্তী" শ্রেষ্ঠ।

              মূলতঃ কবি হলেও গদ্য রচনাটি ও তিনি তাঁর পরিশীলিত চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। ছোট গল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাসেও তিনি স্বচ্ছন্দ । রম্য রচনাতে তাঁর মননশীলতার পরিচয় পাই। গদ্য সাহিত্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর ভাষার সৌজন্যে । তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে রচিত
"তপস্বী ও তরঙ্গিনী" (১৯৬৬), "কালসন্ধ্যা"(১৯৬৯),
"অনাম্নী অঙ্গনা "(১৯৬৯), "প্রথম পার্থ"(১৯৭০), "সংক্রান্তি"(১৯৭৩) - র মত কাব্যনাটক রচনা করেন ।

           তিনি দেশি-বিদেশি কবিদের কাব্য ও কবিতার অনুবাদ ও অনুলিখনও করেছিলেন । কালিদাস ( মেঘদুত), শংকরাচার্য ( আনন্দলহরী),
য়ুয়ান চন , বরিস পাস্টেরনাক , এজরা পাউন্ড , কামিংস , শার্ল বোদলেয়ার, রিলকে প্রভৃতি কবির কবিতা অনুবাদ করেন ।  বুদ্ধদেব বসু ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ‌। ফলে তাঁর রচনায় আমরা এজরা পাউন্ড, শার্ল বোদলেয়ার, লরেন্স, রিলকে , র‍্যাঁবো , এলিয়ট প্রমুখ কবির সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাই ।

               এক সময় তাঁর লেখায় অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল । এজন্য তাঁকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে ।

"তবু, ঈষদচ্ছ , এখনো ছায়ারহিত,
প'ড়ে রইল , এক ঝাড় এপ্রিলের বার্চগাছের মতো,
উষ্ণ, শূন্য, উন্মুক্ত যোনিদেশ ।"
( 'ভেনাসের জন্ম')

আর একটা উদ্ধৃতি দেই :

"দেখো, মোর বুকে দুটি পাকা ফল ভরেছে রসে---
বাসনার রসে সকল কালের সব পুরুষের । ....."
("কঙ্কাবতী" কাব্যগ্রন্থ থেকে)

                  বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ কবি । তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য তিনি যেমন নন্দিত হয়েছেন, আবার নিন্দিতও হয়েছেন।
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সমকালীন সাহিত্য কোন নিরালম্ব বায়ুভূক বস্তু নয় । অতীতের সঙ্গে রয়েছে তাঁর নাড়ির যোগ ও টান । তিনি চিরন্তন যৌবনের কবি ।।

_______________________________________
লেখক ---- অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া হুগলি।

_________________________________________
ঋণ স্বীকার :

১/  "আধুনিক কবি ও কবিতা" -- বুদ্ধদেব বসু ---- নন্দলাল মাইতি ।
২/ "আমার কালের কয়েকজন কবি" --- জগদীশ ভট্টাচার্য ।
৩/ বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা ---- দে'জ পাবলিশিং
_________________________________________

২টি মন্তব্য: