গল্প- নিজের পরিচয় সেক আসাদ আহমেদ
Story- Nijer Porichoy by SK Asad Ahamed
|
গল্প- নিজের পরিচয় সেক আসাদ আহমেদ |
সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত সেক আসাদ আহমেদ এর গল্প....
নিজের পরিচয়
সেক আসাদ আহমেদ
(প্রথম অংশ)
দুপুর ১টা
রতনপুর প্রাইমারি স্কুলে টিফিনের ঘন্টা বেজে উঠল। বৈশাখ মাসের কড়া রোদ্দুর। ভ্যাপসা গরমে বাইরে বেরুনো দায়। গা যেন পুড়ে যায়, তাই হেডমাস্টার মশাই স্কুলের বাইরে বেরুতে বারণ করেছেন। কিন্তু আজ একমাত্র ব্যাতিক্রম হল খালেক। কখনও শিক্ষকের আদেশ অমান্য করেনি, তবুও প্রচন্ড গরমে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
আজ স্কুলে আসার পর থেকে মনটা কেমন ছটফট করছিল। কিছু ভালো লাগছিল না ওর, নিয়মিত ক্লাসে পড়া দেয়। কিন্তু আজ পড়া করে এসেও পড়া দিতে পারেনি। এর জন্য ক্লাস টিচারের বকুনি ও খেতে হয়েছে।
কেন? কেন সে পড়া দিতে পারেনি ?— মনে প্রশ্ন জাগল তার।
বাড়িতে তো মা অসুস্থ! কিছু হয়নি তো? ভাবতেই গা শিউরে উঠল।
বাড়ি থেকে স্কুল মাত্র ৭ মিনিটের হাঁটা পথ।
এগিয়ে চলল খালেক।
মোড়ের রাস্তায় রাইসু জেঠুর কাছে খবর পেল মা হাসপাতালে। আর কোনো কথা না শুনে সোজা দৌড় দিল ওদিকে। হাসপাতালে পৌঁছে দেখল বাবার চোখে জল...
এখন সারাদিন বাড়িতে একা থাকে খালেক।
বাবাকে তো পেটের জন্য ফেরি করতে যেতে হয়। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করেনা, স্কুলেও যায় না। যেখানে সেখানে একা বসে কাঁদে। মনের আনন্দ যে ওর হারিয়ে গেছে।
এই অল্পবয়েসী শিশুকে কে মানুষ করবে? কে তার হারানো মুখের হাসি এনে দেবে। এভাবে আর কতদিন চলতে পারে।
শেষে ইউসুফ বাবু ঠিক করলেন ওর জন্য নতুন মা আনবেন।
নতুন মা পেয়ে তার মুখে সত্যি হাসি এল, কিন্তু তা বেশিদিন নয়।
কথায় বলে ফুটো কলসিতে আর কতক্ষণ জল ভর্তি থাকে।
খালেক যখন ১১ বছরের হল তখন বিমাতার পুত্র সন্তান হল।
নতুন মা আর যেন ভালোবাসে না। কেমন যেন হিংসুটে হয়ে গেছে, কথায় অকথায় গলা চড়ায়। বাড়ির কাজ কর্ম করায়... এমনকি এঁঠো থালা-বাসন ও মাজিয়ে নেয়।
বাবাকে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। তাই মুখ বুজে সব সহ্য করেছে।
(দ্বিতীয় অংশ)
বাবার ইচ্ছা না থাকলে ও বিমাতার লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেতে খালেক কলকাতায় চলে এল। বিমাতার মামাতো ভাই কাজের কথা বলে আসলে এক বিহারীবাবুর বাড়িতে কিছু টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিল। এসব কিছুই বুঝতে পারেনি খালেক।
তবে বিমাতার লাঞ্ছনা থেকে নতুন শহরে বেশ ভালো লাগছে। সন্তানহীন বিহারীবাবুর বাড়িতে ছেলের মতো থাকে আর পুরো বাড়িটি দেখাশোনা করে,
জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে,
পরিষ্কার করে।
নিজের হাতে ইচ্ছে মতো খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতেই স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু একটা পরাধীনতাও ছিল। কখনও গেটের বাইরে বেরুনো যাবে না।
গ্রামের মুক্ত পরিবেশের ছেলে হয়েও মেনে নিয়েছিল খালেক — এটাই সে জীবনে চরম ভুল করে ফেলে ছিল। চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে জীবন্ত আত্মার কবর দিয়েছে সে। জীবনটাকে নিসঙ্গ একগুঁয়েমি করে তুলেছে পৃথিবীর কেউ যেন এই প্রথম জীবনের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছে। কলরবপূর্ণ শহরে থেকেও কলরব শুনতে পায়নি। বুঝতে পারেনি চার দেওয়ালের ভেতরকার স্বার্থের কলরব।
কাটিয়েছে জীবনের পরবর্তী ৭টা বছর...
খালেক এখন ১৮ বছরের।
তবে শরীরে যৌবনের ছাপ নেই, লম্বা ও শীর্ণ দেহ। উসকু-খুসকু চুল। শরীরটা বুড়োর মতো সামনে দিকে ঝুঁকে পড়েছে ।
এখনও ছেলেবয়েসী স্বভাব কাটেনি, কথা বলতে ও শেখেনি।
তবে একদিন ভোর প্রায় তিন টা। দরজায় কেউ টোক্কা দিচ্ছে।
কী ব্যাপার? এত তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেল নাকি?
ঘড়ির দিকে তাকাল খালেক — না তো। কোন রকম চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলল।
সামনে বিহারীবাবু দাঁড়িয়ে , কিছুটা অচকিত লাগছিল তাকে। কিন্তু কিছু না বলার আগে সহেব বললেন - আমি তিন দিনের জন্য দিল্লি যাচ্ছি ব্যবসার কাজে। এই কদিন তুই একা সাবধানে থাকিস।
—ঠিক আছে বাবু
তারপর বিহারীবাবুকে গেটের কাছে পৌঁছে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল খালেক।
তৃতীয় অংশ
এভাবে দুদিন কেটে গেল, তিন দিনের সময় কেউ যেন দরজায় টোক্কা দিচ্ছে।
প্রত্যেক দিন সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে, কিন্তু ক'দিন কিছু কাজ না থাকায় একটু দেরি করে উঠছে সে। তাই আজও ঘুমিয়ে ছিল।
সাহেব মনে হয় ফিরে এসেছেন ।
তার মনে ভয় জাগল, আজ বকাঝকা শুনতেই হবে । ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতেই — সামনে উর্দি পরা কয়েকজন লোক।
অবাক হয়ে খালেক প্রশ্ন করল — তুমরা কারা? সঠিক বাংলা ও জানে না সে।
কিছুটা হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে কথা বলে। এককথায় যাকে বলে খট্টা বাংলা । অথবা আধো বাংলা ও বলতে পারেন।
— আমরা পুলিশ
পুলিশ! পুলিশ বলে নাম শুনেছে কিন্তু কখনও স্বচক্ষে এত কাছে দেখেনি। তাছাড়া পুলিশের ভয় মা দেখাতো। তাই ভয়টা যে আরও বেশি বেড়ে গেল।
আবার কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল — কায় এসেছে?
একজন উর্দি পরা লোক বললেন — তুই খুন করেছিস।
অন্য একজন উর্দি পরা লোক হাতে লোহার বেড়ি পরিয়ে দিল।
খুন !!! সেটা আবার কী?
জীবনে এই প্রথম খুন কথাটি শুনল খালেক। খুনের মানে কী তার জানা নেই, অথচ সে নাকি খুন করেছে।
আবার উর্দি পরা লোকটি বললেন— হুম, মানুষ মেরে আবার ন্যাকা সাজা হচ্ছে। চল ব্যাটা নীচে চল — দেখাচ্ছি তোকে।
এমন সময় বাড়ির নীচু তলায় হইচই -এর আওয়াজ শোনা গেল। উর্দি পরা লোকেরা তাকে নীচে নিয়ে এল।
একটি মানুষের লাশ, ৪০-৪৫ বয়সী হবে। পচা দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। নীচু তলার গুদাম ঘর থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে।
এমন সময় একজন পুলিশ খাটের তলা থেকে রক্তে রাঙানো ছুরি বের করল।
খালেক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল... কী অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটে যাচ্ছে তার চোখের সামনে, অথচ সে কিছুই করেনি।
তার মাথায় যেন বাজ পড়ল, বন্ বন্ করে মাথা ঘুরতে লাগল। হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল ।
তারপর কিছুই মনে নেই তার...
চতুর্থ অংশ
প্রায় মিনিট বাইশের পর যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন অবাক হয়ে চেয়ে দেখল — চারিদিকে দেওয়াল, সামনে লোহার রেলিং আর গাঢ় অন্ধকার।
সে বলে উঠল — হামি কোথায়?
এমন সময় এক উর্দি পরা লোককে দেখতে পেয়ে তার সব কথা মনে পড়ল।
তখন সে মনে মনে বলল আমি তো কোনো ভুল করিনি ? আমায় কেন বন্দী করা হল ?
মনের মধ্যে তার ভয়টা আরও বেড়ে গেল।
হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল এবং আধো বাংলায় চেঁচিয়ে উঠল — হামায় বিশ্বাস করুন, হামি খুন করিনি, হামি খুন............
কিন্তু ভাগ্য সহায় নেই কেউ শোনেনি তার করুণ আর্তনাদ। যাকে দেখে তাকেই বলে উঠে — হামায় বিশ্বাস করুন, হামি খুন.........
নিরপরাধে খুনের দায়ে তার জেল হল।
যখন যাকে দেখে সেই একই বাক্য উচ্চারণ করে
আর কাঁদতে থাকে,
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমের ঘোরে ঢুলিয়ে পড়ে।
পঞ্চম অংশ
শেষে একদিন ভাগ্য সহায় দিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর জেলে কাটানোর পর একদিন এক নতুন জেলার মুর্শিদাবাদ থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। প্রথম দিন এসে তিনি গোটা জেল ঘুরে দেখতে লাগলেন।
এমন সময় তিনি শুনতে পান — হামায় বিশ্বাস করুন , হামি খুন করিনি, হামি খুন.......
খালেক দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে যাকে দেখে এই বাক্য উচ্চারণ করে। এটি তার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। তাই সবার কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে উঠেছে তার এই করুণ আর্তবাক্য।
নতুন জেলারের মনে কেমন যেন খটকা লাগল। তিনি এগিয়ে খালেকের কাছে, দেখলেন এক অল্প বয়সি যুবক পশ্চিম দিকে মাথা করে হাঁটু গেড়ে বলছে সেই একই বাক্য।
—হামায় বিশ্বাস........হামি খুন......
সবাই তাকে পাগল ভাবলেও নতুন জেলারের মনে হল যুবকটি যেন সত্যি কথা বলছে।
তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না।
গার্ডকে আদেশ দিলেন লক্ আপ খুলতে।
দরজা খুলার শব্দে উঠে বসল খালেক এবং ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চার দেওয়ালের এক কোণে সরে বসল কিন্তু মুখে সেই একই বাক্য উচ্চারণ করতে থাকল।
জেলার সাহেব আস্তে আস্তে তার কাছে এগিয়ে এলেন এবং মাথায় হাত বুলিয়ে অতি ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন
— তোমার নাম কী?
খালেক আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকাল উর্দি পরা লোকটার দিকে। কেন? কেন বলতে যাব আমার নাম টা? এত দিন কত এল গেল কেউ জিজ্ঞেস করেনি।
——না বলব না ।
হঠাৎ তার কানে কাছে মিষ্টি শব্দ ভেসে এল এবং এক ধরনের অদ্ভুত গন্ধে ভরে গেল চার দেওয়ালের অন্ধকার বন্দীশালাটা।
দেরি কর না বলে দাও, বাড়ি যেতে চাও না নাকী?
হুমম চাই! চাই!
আমি বাড়ি যাব! আমি বাড়ি যাব!
জেলার সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন — কী হল বল তোমার নাম কী?
— বলছি - বলছি
নিজের নামটাই যেন ভুলে গেছে, অনেক ভেবে চিন্তে শেষে বলল — খালেক মহম্মদ।
— বাড়ি কোথায়?
— রতনপুর। এটাও অনেক ভেবে চিন্তে বলল।
— রতনপুর? মানে দীঘা?
— হুুঁম
— বাবার নাম?
— ইউসুফ মহম্মদ
— ইউসুফ মহম্মদ! জেলার সাহেব যেন চমকে উঠলেন, কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেলেন।
আবার জিজ্ঞেস করলেন
— মায়ের নাম?
খালেকের চোখে জল ভরে এল। মাথা নীচু করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
— ইয়াসিনা
কী? তুমি ইয়াসিনার ছেলে? জেলার সাহেব দূরে সরে গেলেন। মনে হয় মাথায় যেন বাজ পড়ল। খালেক স্থির ভাবে লক্ষ্য করল জেলার সাহেবের চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠেছে। এসব কিছু দেখে খালেক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ লোকটি মায়ের নাম শুনে অমন হল কেন? তিনি কী মায়ের কোনো আত্মীয়? এসব কিছুই উত্তর খুঁজে পেল না খালেক।
ষষ্ঠ অংশ
সেদিন গভীর রাতে আবার এলেন জেলার সাহেব। একের পর এক সব ঘটনা শুনলেন খালেকের কাছে। খালেক সত্যি নির্দ্বিধায় সব সত্যি ঘটনা খুলে বলল। দুজনেরই চোখে জল ভরে এল। আর এক মূহুর্তের জন্য অপেক্ষা না করে জেলার সাহেব বেরিয়ে গেলেন ।
পরের দুদিন পর পর এসেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ দু-সপ্তাহ আর মেলেনি।
শেষে একদিন এক পুলিশ পাহারাদার এসে বলল— বাইরে এসো
——বাইরে এসো? মানে?
— তোমার সাজা মুকুব হয়েছে
— মুকুব হয়ে গেছে? আরে আরও তো দু'বছর বাকি। যেন বিশ্বাস হয়না খালেকের। কিছুটা বিশ্বাস অবিশ্বাস এর মাঝে সত্যতা লুকিয়ে রয়েছে।
হঠাৎ চার দেওয়ালের মধ্যে মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল । গন্ধটা খুব চেনা খালেকের। প্রতি রাতে এই চেনা গন্ধ ঘুম পাড়িয়ে যেত।
— আচ্ছা এতো তাড়াতাড়ি সাজা মুকুব হয়ে গেল কেন?
—তা জানিনা। বাইরে এসো। আমার পিছনে পিছনে এসো। জেলার সাহেবের হুকুম।
পাহারাদারের কথা মতো এগিয়ে চলল খালেক। জেলার সাহেবের ঘরে ঢুকিয়ে স্যালুট করে বিদায় নিল পাহারাদার।
খালেক লক্ষ্য করল সেই নতুন উর্দি পরা লোকটি মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছেন।
তিনি অন্য উর্দি পরা লোকটিকে কী নির্দেশ করলেন। সে ভাষার কিছু বোধগম্য হয়নি খালেকের।
0666 তো?
——হাঁ জ্বি
— এখানে এসো
কথা মতো উপস্থিত হল খালেক। তিনি সই করতে বললেন।
কেন সে সই করবে? কী ব্যাপার ? সাজা কী সত্যি মুকুব হল। জিজ্ঞেস করবে ভাবলেও সাহস করে উঠতে পারেনি।
সই করল খালেক
হাত দেখাও স্ট্যাম্প দিতে হবে।
তৎক্ষণাৎ জেলার সাহেব বললেন— না - না! আমার কাছে পাঠাও।
জেলার সাহেব নিজের মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা দিলেন এবং বললেন যাও আজই বাড়ি চলে যাও।
হঠাৎ খালেক বলে বসল রাস্তা জানি নে।
জেলার সাহেব তাকে সব বুঝিয়ে দিলেন এবং নিজের ড্রাইভারকে ডেকে পাঠালেন।
ড্রাইভারের সঙ্গে সঙ্গে বাসস্টোপের দিকে চলল খালেক।
আসার হঠাৎ পিছন ফিরে তাকল খালেক দেখল নতুন জেলার সাহেবের দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
সপ্তম অংশ
বিকেল সাড়ে পাঁচটা।
দীঘা সায়েন্স সেন্টার রতনপুরে পৌঁছালো। রাস্তাঘাট কেমন যেন বদলে গেছে, বাড়ি কোথায় বুঝে উঠতে পারছে না। বুঝবে কেমন করে দীর্ঘ ১২ বছর চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থেকে সবই যেন ভুলে গেছে সে। কাউকে কী জিজ্ঞাসা করবে, কেমন লজ্জাবোধ হয় তার।
তাছাড়া কে?
এতদিন কোথায় ছিলে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তাকে।
এদিক ওদিক কেমন থতমত খাচ্ছিল সে। অনেকক্ষন এদিক ওদিক ঘোরা ঘুরি করে কিছুই খুজে পেল না। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে । ভাবনা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ এক বুড়ি মা এগিয়ে এলেন। পরনে সাদা শাড়ি মাথার চুল সাদা। কেমন যেন একটা গন্ধ ও ভেসে এল অনেক চেনা গন্ধ টা। কেমন অস্থির হয়ে উঠল সে।
— তুমি বাড়ি যাবে বাবা? কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন বুড়ি মা।
— হ্যাঁ আমি বাড়ি যাব। হতভম্ব হয়ে বলল খালেক
— তুমি খালেক তো?
অবাক হল খালেক, ইতস্তত বোধ করল খালেক তবুও জবাব দিল — হ্যাঁ।
— আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারলাম না?
— চিনতে পারবে না বাবা।
তিনি মাথা নাড়াতে নাড়াতে ঘুরে পড়ে এগিয়ে চললেন।
কী করবে খালেক কিছু বুঝতে পারছে না, এদিকে সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এল। সে ও এগিয়ে চলল পিছনে পিছনে।
আবার হঠাৎ বুড়ি মা বলে উঠলেন — তোমায় একটা সুখবর দিই বাবা ।
— সুখবর! কী সুখবর? তাছাড়া আপনিই বা কে?
— আরে আগে শোনো তো বাবা। যে জেলার সাহেব তোমার সাজা মকুব করছে, সে কে জানো?
কী???? একেবারে চমকে উঠল খালেক
কিছু টা অপ্রস্তুতভাবে বলল — না, জানি না, তিনি কে?
সত্যিই তো তিনি কে? কেনই বা সাজা মকুব হল, নিজেকে প্রশ্ন করল । কোনো উত্তর খুঁজে পেল না সে।
খালেক বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগল কেমন করে এ বুড়ি মা আমার গোপন রহস্য জানল ।
একই কোনো ফকির সন্ন্যাসী? নাকি জিন?
এসবের উত্তর খুঁজে পেল না, খুব ভয় হচ্ছে তার, চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল। পিছনের দিকে দৌড়ে পালাবে ভাবল সে। কিন্তু পিছনে গাঢ় অন্ধকার, কী করে যাবে সে।
সামনে বুড়িমার পরনে সাদা শাড়ি যেন ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে পথ দেখাচ্ছে।
এসব দেখে ভয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল, হাত-পা কাঁপতে লাগল তার।
কী বাবা , কী ভাবছ? ও তুমি ভয় পাচ্ছো ,
কোনো নেই বাবা — বুড়ি মা পিছন ফিরে বললেন।
না, কিছু না, না ——না —কিছুটা থতমত হয়ে বলল খালেক আবার এগিয়ে চলল।
— তবে যা বলছি শোনো।
তারপর বুড়ি মা বলতে শুরু করলেন —
আজ থেকে ২৪ বছর আগে তোমার বাবার পরিচয় হয় দীঘায় একটি মেয়ের সাথে, মেয়েটি মুর্শিদাবাদ থেকে পরিবারের সাথে বেড়াতে এসে ছিল, তখন তোমার বাবা দীঘা সায়েন্স সিটির 'আকাশ-নক্ষত্র' প্রদশর্নীতে প্রজেক্টর হিসেবে কাজ কাজ করত। সেই সূত্রে তাদের দুজনের পরিচয়।
প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর প্রেম... কিন্তু মেয়ের বাবা তা মেনে নেয়নি। পরে কিন্তু মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিল। পরে কিন্তু মেয়ে জামাইকে নিতে এসেছিলেন কিন্তু তার মেয়ে নিজে যেতে চায়নি।
কারণ ওর ভয় করে ওর বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। এখন নিয়ে গিয়ে পাছে স্বামীকে জেলে পুরে দেয়, মেয়েটির বাবা জীবনে মেয়ের মুখ দেখবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে সেই যে গেছেন আর কোনোদিনই আসেননি।
এখন তিনি জেলার সাহেব...
কথা শেষে বুড়ি মা বললেন — বাবা এইতো তোমার বাড়ি...
বাড়ির কথা শুনে বুড়ি মাকে পেরিয়ে চোখভরে দেখতে লাগল।
কথা বন্ধ, হঠাৎ পিছন ফিরে দেখল বুড়ি মা ও নেই, আর সেই চেনা মিষ্টি গন্ধও নেই।
খালেক অবাক দৃষ্টিতে পিছনের দিকে তাকিয়ে রইল আর বলল
— যা বুড়িমা তো নিজের পরিচয় বলল না?
সমাপ্ত
বি:দ্র:- এই গল্পের কোনো অংশ কপি করা বা মুদ্রণ করা দন্ডনীয় অপরাধ