শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

গল্প : টান লেখক: দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

  উৎসাহিত ও আবেগস্নাত বন্ধুদের শুভেচ্ছা আগেই জানিয়ে দিয়েছে ডিসেম্বর ২০২০ গৃহশোভা পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প " টান" তাদের টেনেছে......যে সব বন্ধুদের গল্পটি এখনও পড়ার সুযোগ হয়নি তাদের ভালোবাসার অনুরোধে.......

             

                         গল্প : টান

                      লেখক: দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

        সবুজ ঘাসের ওপর চাপ চাপ রক্তের দাগ। জানোয়ার ও সহ্য করতে করতে একসময় ফুঁসে ওঠে।আর এরা তো মানুষ ! দীর্ঘ দিনের বঞ্চনার লাভা স্রোত তো এরকম হবেই !

   ডুয়ার্সের লাবডুঙ চা বাগান । ছোট্ট চাবাগান।তাই চা পাতার উৎপাদনও কম ।মালিকের অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশা প্রায়  অনাহারে  থাকা শ্রমিকদের বঞ্চনার আগুনে পুড়িয়েছে দীর্ঘ দিন। পরিণাম মালিক রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার থ্যাতলানো রক্তাক্ত শরীর ঘিরে জেগে থাকা একরাশ প্রশ্ন ও হতাশা।

   কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শেষ করেই ইউ পি এস সির চাকরিটা জুটে গেল। স্ট্যাটিসটিকাল ইনভেস্টিগেটর কাম অফিসার । অনেক পরিশ্রম ছিল তার জন্য। মেধাবী অভীক পেরেকটা ঠিক জায়গাতেই পুততে পেরেছিল। বেশ মোটা মাইনে।কাটাকলের আরো দুজন পেল। অর্ক ও দেবারতি।

   দেবারতি কিছুদিন পরেই বার্কলে ইউনিভার্সিটি তে গবেষণা করতে চলে গেল। অর্করও  পালাই পালাই ভাব।কলেজ সার্ভিস কমিশনের দিকে তাকিয়ে বসে। প্রথম দিন থেকেই চা বাগানের এতো সমস্যার মাঝেও অভীক আস্তে আস্তে মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে কোথায় যেন ও একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করতে পেরেছিল। মায়ের কথাটা মনে ছিল,ফেস দ্য ব্রুট। চোখে চোখ রেখে সমস্যার মোকাবিলা। শেষ সাক্ষাতে বিদ্যা মন্দিরের দীপঙ্কর মহারাজের কথাটা যেন কানে বাজে ওর: মানুষের জন্যও  কিছু করিস !

   আলিপুরদুয়ার ষ্টেশন রোডের শেষে ওর অফিস । ডি এম অফিস লাগোয়া ।ওর থাকার জায়গা কিন্তু কাছাকাছি চা বাগান কোরাঙগিনির বাংলোয়।ভারী মনোরম পরিবেশ। আলিপুরদুয়ারের বারোটা চা বাগানের বর্তমান অর্থনৈতিক চিত্র ,শ্রমিকদের অবস্থা, অনুন্নয়নের কারণ থাকলে তার খোঁজ  ও উন্নয়নের নকশা বানানো। তবে সবকিছুর মূলে যেন থাকে শ্রমিকের সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। এক কথায়,মানব মূলধনের রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় ওকে।আর মাথার ওপর ডি এম , অশোক ভুটিয়া।

   ডি এম ভালো বাংলা বলতে পারেন। শিবপুরের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। প্রচন্ড মেধাবী।হাই পাওয়ার গ্লাসের নীচে দুটো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। প্রশাসন টা দারুন বোঝেন। খুব বড়ো মনের মানুষ। কর্মীদের বিপদতারণ তিনি। কর্মীরাও তার জন্য প্রাণম উৎসৃজেৎ।এক মন ভালো করা পরিবেশ ওনার অফিসে।

   প্রথম দিন থেকেই অভীকের সাথে ভালোলাগার সম্পর্ক ডি এমের।ওনার স্ত্রী বাঙ্গালী। ভালো গানের গলা। সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। অশোক বাবু আবার কবি মানুষ। লেখালেখি করেন অবসরে। অভীকের কবিতা পড়ে একদম আপ্লুত। তবে ও অন্য একটা কারণও বুঝতে পেরেছে। ওনার মৃত ছেলে আকাশের সাথে নাকি ওর অনেক মিল।তাই ভালোলাগায় অপত্য স্নেহের ভাগই বেশি পায় ও।

   সহজ সরল মানুষগুলোর জন্য ও একটা টান অনুভব করে এখন। সত্যিই এরা যেন প্রকৃতির সন্তান। সবুজের মাঝে যেন এক একটা সবুজ মানুষ। বঞ্চনা অবজ্ঞা এদের দিনলিপি।ওর বাবার কথা মনে পড়ে খুব। সমাজবিজ্ঞানী বাবা বলতেন: রাস্ট্র সব মানুষের সমস্যার কাছে সবসময় পৌঁছতে পারবে না। ট্রিকল ডাউন থিওরি থাকবেই।মানে গাছের ওপরের পাতা বেশি জল পাবে আর নিচের পাতায় জল চুঁইয়ে পড়বে। সরকারি সুবিধা কিছু মানুষের কাছে বেশি মাত্রায় যাবে।তাই বেশি-পাওয়া মানুষগুলো যখন কম-পাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে তখনই হবে প্রকৃত উন্নয়ন। ' তখনই বাস্তব হবে 'আশ্চর্য ভাতের গন্ধ'  প্রতি ঘরে।

      আলিপুরদুয়ারের চা বাগানগুলোতে চা পাতার উৎপাদন অন্যান্য বাগানের তুলনায় অনেক কম । মালিকরা উৎপাদন বেশি করতে চায় ।চা বাগান ম্যানেজারদের নিয়ে বৈঠকে অভীক বেশ কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে,বহু পুরানো চা গাছগুলো থেকে বেশি উৎপাদন আশা করা বৃথা।কচি পাতা উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে গাছগুলো। নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেও বিপুল আর্থিক চাপের কারণে পিছিয়ে আসছে অধিকাংশ চাবাগানের মালিকরা।

  আর কথায় আছে, সুস্থ শরীরে বাস করে সুস্থ মন। অপুষ্টি যেখানে যাপন চিত্র, সেখানে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা সর্বাধিক আশা করা যে কাঁঠালের আমসত্ত্ব ! উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি প্রথম প্রয়োজন। দিন প্রতি একশো টাকায়  অন্ততঃ চারজনের একটা পরিবারের ভালো ভাবে চলা এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে খুবই কষ্টকর।তাই লাভের অঙ্ক কষার সাথে শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে বাঁচার হিসাবটাও কষা দরকার।

   চা বাগান গুলোতে শ্রমিকদের বাঁচা সত্যিই নিম্নমানের। হাজারো না পাওয়ার মাঝে বেঁচে থাকা ওদের । এদের জন্য কিছু করার ইচ্ছায় ছিলই ও ।সাহসী  অভীক একটা কান্ড করে বসলো । বেশ কয়েকবার চাবাগান শ্রমিকদের অবস্থা জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রককে কিছু করার আর্জি জানিয়ে ও মেল করেছে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা ! হঠাৎ সুযোগটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই এসে গেল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে চাবাগান উন্নয়ন মন্ত্রী আলিপুরদুয়ার চাবাগান পরিদর্শনে আসেন।ডি এম, লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার,অভীক ও অবস্থা খারাপ এমন চা বাগানের মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী।আশোকবাবুকে বার বার অনুরোধ করে অভীক আলোচনার স্থান কোরাঙগিনি চা বাগানের অডিটোরিয়ামে করতে বলে।

     উদ্দেশ্য একটাই ছিল এর পিছনে। অন্য বাগানগুলোর থেকে কোরাঙগিনি অনেক টাই পিছিয়ে। উৎপাদন কম এখানে । এটাকে মালিকরা ঢাল করে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া থেকে বঞ্চিত করে আসছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজের চোখে দেখে যাক শ্রমিকদের অবস্থাটা।

   আশানুরূপ কাজই হলো। মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে চা বাগানের মালিকরা শ্রমিকদের অবস্থা বোঝাতে ভুল তথ্য দিতে থাকল । মন্ত্রী ওকে শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থাটা বোঝানোর কথা বলতেই অভীক  কান্ডটা করে বসে। সামনে থাকা জল ভর্তি গ্লাসের মধ্যে নিজের পেনটা ডুবিয়ে দিয়ে মন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে বসে:পেনটা ঠিক কি দেখছেন , বাঁকা না সোজা? বাকরহিত মন্ত্রী ও অন্যরা।এরকম উপস্থাপনা ওরা আশাই করেননি। মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে ও বুঝলো, কেল্লা ফতে !জল মাধ্যমের মধ্য দিয়ে দেখলে পেন তো বাঁকা দেখাবেই। অর্থাৎ ম্যানেজারদের চোখে শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে গেলে তা সত্য হবে না। অবস্থার অসদ বিম্বটাই ধরা পড়বে এবং তাতে  মালিকদেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।

   এরপর সবকিছু ওর পরিকল্পনা মাফিকই হল। শ্রমিক কলোনিতে গিয়ে তাদের ঘর, শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা দেখে আবেগ তাড়িত মন্ত্রী। বাগানের ম্যানেজারকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সবকিছু ঠিকঠাক করতে নির্দেশ দিলেন। দেখভালের দায়িত্ব দিলেন ডি এমকে। শ্রমিকদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির একটা মাস্টার প্ল্যান বানাতে বললেন অভীককে।ওর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে আগামী মাসে দিল্লি আসার প্রস্তাব দিলেন।অশোকবাবুর উৎফুল্ল মুখ বলে দিল ওনার খুশির কথা।

  অভীক মনে মনে এটাই চাইছিল। শ্রমিকদের বাঁচার অযোগ্য পরিবেশের কথা প্রচার করতে হবে ব্যাপকভাবে। লজ্জায় ফেলতে হবে সভ্য সমাজকে। বোঝাতে হবে, পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। উন্নয়নের কর্ম যজ্ঞে এদের ব্রাত্য করা যাবে না। তবে যদি কাজ হয়। কদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী চাবাগান শ্রমিকদের বিনা পয়সায় চাল ডাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে অবস্থা কতটা শোধরাবে !

      সারা চাবাগানে এখন শুধু দিন বদলের স্বপ্ন। অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলোর কাছে অভীক এখন নয়নের মনি।ও প্রত্যাশার চাপটা বোঝে। দিল্লি যাওয়ার তোড়জোর চলছে। পুরো দায়িত্ব ডি এম নিজে নিয়েছেন। সারা সময় ধরে উন্নয়নের রুপরেখা বানিয়ে চলেছে ও। স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে টি ট্যুরিজমের প্রস্তাব রাখছে। টি ট্যুরিজম হলে বাগানের পুরুষগুলো হোটেল,দোকান , রিক্সা বা ভ্যান চালানো অথবা গাইডের কাজ করতে পারবে। সহায়ক অর্থনীতি । মহিলাদের চাপাতা তোলার সাথে সাথে পুরুষগুলোও কিছু আয় করলে বাঁচার পরিবেশ, পদ্ধতি আস্তে আস্তে বদলাবে নিশ্চিত। বাচ্চা গুলো স্কুলে যেতে শুরু করবে । দিনের শেষে মাতাল মরদগুলো ভূমিকা বদলে তখন হয়ে উঠবে প্রেমিক সোয়ামী !

   সারা রাত প্রজেক্টটার কাজ করে শুতে অনেক দেরি হয়েছে ওর। সঞ্চিতাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করেছে অনেক বার। পায়নি। মেয়েটা বড়ো মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে ওকে।প্রতি মূহুর্তে ওর ভালো বাসা অনুভব করে অভীক । কতো দিন দেখা হয় নি ! একরাশ মন খারাপ নিয়ে শুতে গেল ও।

     পরদিন সকালে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো ওর।কি হলো আবার ! বাইরে বেড়িয়েই চমক! ও কি স্বপ্ন দেখছে ? একেই কি টেলিপ্যাথি বলে ? কাল যার কথা মনে করেছে বারবার সেই এখন সামনে। মূর্তিমান বর্তমান। আনন্দে উত্তেজনায় নীচে নেমে দেখল চা বাগানের মেয়ে দের মাঝে সঞ্চিতা । অভীকের মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ল সকলের মাঝে আনন্দ ঝর্ণা হয়ে। সঞ্চিতা সকলকে জানিয়ে দিল, দুদিন থাকবে ও এখানে ।ঐ দিন সকলের জোরাজুরিতে রাত্রে খাওয়াদাওয়া, ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন। অনেক রাত অব্দি চলল নাচগান। সারা চাবাগানে যেন নতুন প্রাণের উৎসব। সঞ্চিতা যেন বঞ্চিত মানুষ গুলোর মনে রাশি রাশি আনন্দ উল্লাসের জ্যোছনা ছড়িয়ে দিল। 

     পরদিন সকালে খুশির খবর আবার ! অশোকবাবু সকালের খবরের কাগজ টা পাঠিয়ে দিয়েছেন বাহাদুরের হাত দিয়ে। মন্ত্রী  কথা রেখেছেন।চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। মালিকপক্ষের সংগঠন ও মেনে নিয়েছে। বাগানের সকলেই এই খুশির খবর  সঞ্চিতা আসার কারণ হিসেবে দেখছে। হাসি হাসি সঞ্চিতার সাথে অভীক ও একরাশ টাটকা বাতাস ভরে নিল আগামীর জন্য।

  দুটো দিন যেন সত্যি ই আনন্দ ভৈরবী ওর জীবনে। সঞ্চিতার মুখে শুনেছে শিলিগুড়িতে ব্যাঙ্ক অফিসারদের ট্রেনিং ছিল।ও ম্যানেজ করে চলে এসেছে অভীকের কাছে। দুদিন পরেই ওকে আবার ফিরতে হবে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে ওর অফিস মালদায় ।স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসে ।

   দুটো দিন হইচই করে কেটেছে ওদের।চাবাগান ঘুরে দেখেছে। প্ল্যান্টে গিয়ে চা পাতা তৈরি দেখেছে। অভীক ওকে ফার্স্ট ফ্লাস চা তৈরি করে খাইয়েছে। মালদায় নিয়ে যাবার জন্য প্যাকও করে দিয়েছে। সঞ্চিতা বাগানের বাচ্চা দের চকোলেট বিলিয়েছে। সঙ্গে আনা জামা কাপড় চা তুলতে আসা মেয়েদের দিয়েছে।সাজের জিনিসের অবস্থা ও তাই। অভীকের মুখে চাবাগানের মানুষগুলোর দুঃখ কষ্টের গল্প শুনে সত্যিই ও মানুষগুলোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে । শুধু সঞ্চিতার সারপ্রাইজ ভিজিটের খবর মাকে জানাতে পারে নি অভীক। দিন পাঁচেক আগে ঝড়ের তান্ডবে মোবাইল টাওয়ারের অবস্থা বারোটা বেজে গেছে। শত যোগাযোগের চেষ্টা তাই ব্যর্থ ।ঠিক হতে কতোদিন লাগবে কে জানে !

   অশোকবাবু ও বৌদিকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছে সঞ্চিতা চলে যাবার আগের রাত্রে। গান আড্ডা গল্প মাউথঅরগানে  ভালো লাগা যেন টুপটাপ ঝরে পড়েছে ওদের ঘিরে সেই সময় ।বিদায় বেলায় চোখের জলে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বৌদিকে। সারা রাত উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা ওদের দুটো শরীর চাঁদের আলো গায়ে মেখে ভালোবেসেছে, আগামীর স্বপ্ন এঁকেছে।ভালো বাসার বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সকালের প্রতীক্ষা করেছে ।

     তবে এ সকাল বড়ো মন খারাপ করা সকাল কোরাঙগিনি চা বাগান জুড়ে। ফোনে ওর মুখে বাগানের মানুষ গুলোর দুঃখ কষ্টের কথা শুনে সঞ্চিতা বলেছিল , একদিন আসবে এখানে। কথা রেখেছে ও।এক সমুদ্র ভালোবাসায় সকলকে ভাসিয়েছে।চা পাতা তুলতে এসে মেয়েরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে । অশোকবাবু ও তনিমা বৌদিরও মন ভালো নেই। সত্যিই যেন জাদু জানে মেয়েটা ! সকলের মতো অভীক ও চাইছে ,আর কদিন থেকে যাক। কিন্তু মুখে বলতে পারে নি। সঞ্চিতা ম্যানেজার হয়ে  বছর খানেক আগে জয়েন করেছে মালদা হেড অফিসে। ওর তাই কাজের বেজায় চাপ ,জানে অভীক । শুধু নির্বাক সাক্ষী থেকেছে বিদায় বেলায় চোখের জল নিয়ে।

   কাল সারা রাত যেন শেষের কবিতার অনুভব ছিল অভীকের কাছে। তারাদের মিটিমিটি ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ সঙ্গে করে সঞ্চিতার স্মৃতির কোলাজ বানিয়েছে ও রাতজাগা হয়ে।কখন আকাশ আলোর খেলায় মেতেছে ও খেয়ালই করেনি। ছোট্ট পাখিটার ডাকে ও যেন জেগে উঠলো মানসঘুম থেকে। জানলায় বসে ল্যাজ দুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে গেয়ে ওকে সুপ্রভাত জানাল পাখিটা।ওর মনের দুঃখের খবর পেয়েছে বোধহয় !

   হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। তাহলে  লাইন ঠিক হল এতোদিনে ! ফোনের ওপাশে মায়ের গলা।ও হ্যালো বলতেই মায়ের কান্নার আওয়াজ।

    এও কি সম্ভব ! শিলিগুড়ি স্টেডিয়ামের পাশে ট্রেনিং সেরে সেবক রোড ধরে হোটেলে আসার পথে পিছন থেকে একটা লরি  ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারে অটোর পিছনে। রাস্তায় ছিটকে পড়লে পাস থেকে একটা ট্যাক্সি চাপা দিয়ে চলে যায়।থ্যাতলানো দেহটা আই সি সি ইউতে লড়েছিল চব্বিশ ঘণ্টা। সে আর নেই ! সঞ্চিতা আর নেই !

   অভীক মাথা ঘুরে পড়ে গেল খাটে। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শরীর জুড়ে। তাহলে দুদিন চাবাগানের মানুষগুলোর মাঝে কাটিয়ে গেল,ও কে? অভীককে ভালোবাসার আবীরে যে রাঙিয়ে গেল,সে কে ?






0 comments: