হাইকু কবিতা
শংকর হালদার
০১।
তপ্ত প্রবাহ
সুপ্ত গহন হাসি
ছন্দ বিহীন ।
০২।
আসবে ভোর
কৃষ্ণ কালিমা মুছে
নব আশ্বাসে ।
০৩ ।
লাগামহীন-
ছন্দে চলে পৃথিবী
ইঙ্গিতে লয় ।
০৪।
শারদ প্রাতেঃ
মাতৃ বন্দনা সুর
আশা জাগায় ।
০৫।
অকাল বৃষ্টি
সৃষ্টিতে আনে ভয়
বিচিত্র নীতি ।
০৬ ।
শ্যাম বনানী
বাঁচার মন্ত্র দানে
সবারি প্রাণে ।
০৭।
প্রভাত রবি
ত্যক্ত আলস্য নিদ্রা
পথ দেখাও ।
ফালু দাসের চিঠি
পার্থ প্রতিম হালদার
প্রিয় দেশবাসী,
আমি 'বিদেশি' ফালু দাস বলছি।
না! এখন আর আমি 'বিদেশি' নই -
আমি স্বর্গীয় ফালু দাস বলছি।
শুনলাম নাকি আর হবে না
'এন আর সি' ?
কয়েক মাস আগে যাদের
তকমা ছিল 'বিদেশি'
তারা এখন আবার 'এদেশি'।
ধন্যবাদ দেশবাসী !
ধন্য আপনাদের 'এন আর সি' !
সেইসঙ্গে ধন্যবাদ জানাচ্ছি
কিছু মহান ব্যক্তি কে,
যাদের কৃপা তে
আমার শবদেহ হয়েছিল 'এদেশি' ।
এবং তাতে আমার পরিবার হয়েছিল
একটু খুশি। কিন্তু আপনাদের
এমন খামখেয়ালীপনা তে
আমি খুশি হতে পারি নি ।
কারণ আমি ভুলতে পারি নি ,
বন্দী শালার পাশবিক অত্যাচার কে ।
ভুলতে পারি নি, ভুল ওষুধ খাইয়ে,
ইলেকট্রিক শর্ট দিয়ে
হত্যা করার দৃশ্য কে।
আমি এখনও শ্মশানে শ্মশানে
হাতড়ে বেড়াই আমার
ভারতীয় নাগরিকত্বের
সমস্ত নথিপত্র কে।
এই সমস্ত নথি থাকা সত্ত্বেও
কেন আমাকে মেরে ফেলা হল,
বানানো হলো 'বিদেশি' -
আমি এর জবাব চাইছি।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি আসামের বন্দী শালার
মৃত বাঙালি দের প্রতিনিধি বলছি।
লিমেরিক
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আসুন দাদা আসুন, নব রূপে সাজুন
দশ টাকাতে পরচুলাতে টাকটা নিজের ঢাকুন
শুনুন বলি তবে
নেইতো লাভ ভেবে
মুখোশেরই কদর এখন, লাজ লজ্জা ছাড়ুন।
বলছে সবাই
বদ্রীনাথ পাল
বলছে সবাই, আমিই ভালো মন্দ মোটেও নই
সব কাজেতে ভালোর ধ্বজা ধরেই আমি রই
এসব শুনে ধরছে মাথা
ভাবছি আমি অন্য কথা
সব ছেড়ে আজ মারছে কেন নেপোয় তবে দই
নদী ও আধুনিকতা
উমর ফারুক
শরতের নীল আকাশ থেকে নদীতে নেমে আসার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে একজন অগান্তুক বড্ড বেশী বিস্মিত হয় ও প্রকৃতির টানে মানুষের মন যতোটা ভিজে তার থেকে ক্ষুধাটা বেশি অনুভব করে। কারণ নদীর পাগলামী একজন মানুষের কাছে বিনোদন স্বরূপ। আবার কখনো কখনো সেই বিনোদন বিপর্যয়ের আবাসভূমি নির্মাণ করে। এটা অভাবনীয় একটি কল্পনা মাত্র । প্রাচীন কাল থেকেই নদীর জীবনের সাথে মিশে আছে সুখ, দুঃখ, অনুভূতি ভাবনা ও অনুপ্রেরনার। শিক্ষার ক্ষেত্রে নানান রকম প্রমান্যা তথ্য পাওয়া যায়। নদী নিয়ে সাহিত্যিকরা নানান ভঙ্গিতে কাব্য রচনা করেন। তার বুকে শুধুই মহাপ্রলয়ের ঝড় তোলে না, তার খিদের যখন যোকের কামর বসায় পেটে তখনই তার তাণ্ডব চালায় আর মানুশের কাছে তা বিনোদন উপভোগ্য বস্তু হারিয়ে যায় । হারাটা ইদানিং আমার কাছে সবচেয়ে অবাক করার মতো।
ব্যাস। বর্ষার জল ঝরা শুরু করলে পাগলামি সীমা অতিক্রম করে সামরিক অভিযানের মত দৌড় দিতেও প্রস্তুত। এইভাবে একটি নদীর জিবন প্রণালীর ধারাবাহিকতা । হঠাৎ করেই জোয়ারের ভিষন তোড়ে উপকূল ঘেঁষে ছুটে যায় আবার কখনো কখনো বয়সের সাথে তাল মানিয়ে নেওয়ার ইচ্ছায় প্রবীণ দের মত আচরণ করে। কিন্তু বন্যার সুসংবাদ পেয়ে তার বুকের সন্তান দের নৃত্য দেখে কে ? জলজ প্রাণীদের সব সময়ই কানাঘুষা করে চলতে হতো এতদিন।
বন্যার জলে মনের আনন্দে ভেসে ওঠা,অন্যের কাছে নিজেকে চমক লাগাতে মন চায় অনেক দিন ধরেই আজ তাদের আশা পূরণ হল।
সকলের বুকে জড়িয়ে হেসে খেলে দিনপাত করে তবে নদীর তীর আর একটি ধনুক তৈরি করে প্রকৃতিকে নিশানা করে নিক্ষেপ করে। এমতবস্থায় যতোটা ভীত সন্ত্রস্ত হয় তার থেকে নদীর ক্ষুধা বেড়ে গেছে দেখা যাবে। কেনো নয় ,নদীর থেকে মানুষ যেন এখনো শিক্ষা নিতে চলেছে। ভালো থাকার জ্বালা কে স্বাগত জানিয়ে খারাপ থাকার জ্বালা কুরবানি করতে দ্বিধ্বাবোধ করে না। এখানে একটি নদীর কথা বলেই আমি চুপ হয়ে থাকব! তা কখনো হয়,কি করে চুপ থাকা যায় ।
ভাগ্যের চাকা সচল রাখতে রূপোর চিরুনি দিয়ে মাথা আচরনো ও একটি আকাশ থেকে নির্মল জল যে জলাশ়গুলোতে মেশে তাতে অনেক কিছুই নিজের মধ্যে ভাবনাকে চেপে ধরে রাখে। সবুজ রং আর সবুজ থাকবেনা বর্ষার তোড়ে কোমর বেঁধে তরঙ্গ ওঠেছে। একবার উদ্ভট কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখি স্নিগ্ধ সকাল বেলায় আপন সুরে নদীর কলকাকলিতে সতেজ হল মন। যেন একশ বছর পূর্তিতে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছি।
সম্ভ্রম রক্ষা, পদমর্যদায় অতি সাধারণ ভাবে মুক্ত হয়ে গেলুম। কেনোনা নদি কে ভালোবেসে তো এরূপ ভাবনা যুগ যুগ ধরেই উদিয়মান হযেছে । প্রাচীন কাল ও তার পূর্বের সময়কালে এত্ত সৌন্দর্যো এখনকার দিনে অন্তত দিনে একবার হলেও কলুষিত হয় । যানজট আর উন্নয়নই প্রধান কারণ নতুবা যুগের পরিবর্তন ।
মেহেরগর সভ্যতায় নদী ছিল তাদের দেবতা। নদী ছিল মা। সব থেকে ভালো আশ্চর্য্যের বিষয় হলো তার ক্ষোভ উগ্রে দেবার সময় হলে কেউ আটকাতে পারেনা। তীব্র জলোচ্ছাস একটা গ্রামকে তোলিয়ে নেয় । গ্রাম ছাড়া হতে হয় হাজারও পরিবারকে। কি বা আর করার ।নদী দেবী কে রুষ্ট করায় তিনি মানুষের কাছে এক প্রকার অবাধ্যতার বসবর্তী হয়ে তার ক্ষোভ উগরে দিলন। এখনই সবাইকে পূজা দিতে হবে।
হ্যা, এরকম ভাবনা ছিল তখন কার যুগের রীতি।
তবুও ভালোবাসা কমেনি গাছের শেকড়ের মত কামড়ে থেকেছে নদীকে। সুনামি, বন্যা কোন পরোওয়া করেনি। নদীর হাব-ভাব আশীর্বাদ হিসেবে কবুল করেছিল বলেই নদীর ও ভালোবাসা জন্মালো মানুষের প্রতি। যদিও তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী পুত পবিত্র রাখার নৈতিক দায়িত্ব । বজ্র পদার্থ নদী ছাড়া অন্যত্র ফেলে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের মন থেকে সেই ঈশ্বর ভক্তি আর নেই। মনের কোন পবিত্রতা নেয়। দিনে রাতে কলুষিত হতে হয় সৃষ্টির হৃৎপিণ্ড নদীকে।
গোলদিঘির পাড়
আব্দুল রাহাজ
হাসান দের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাছপালায় ঘেরা একটা গোল দীঘি ছিল। কী অদ্ভুতভাবে গোল দিঘি ওখানে অবস্থান করছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শোভা সবাইকে যেন মনটা কেড়ে নেয়। এই গোলদিঘি কে কেন্দ্র করে অনেক মানুষ রুটিরুজির জোগাড় করে কারণ এখানে বিকাল হলেই আর শীতের মরশুমে বাইরে থেকে লোক আসে হাসান আলীর বন্ধুরাও যায় সেখানে বেশ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারের দোকান বসেছে একটা ছোট মেলা বললেও ভুল হবে না লোকের আসে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করে প্রকৃতির মহামায়া রুপ । গোলদিঘির দক্ষিণ দিকে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী চামেলি তার হাওয়া আসে গোলদিঘির পারে ফুরফুর বাতাসে সবাই যেন এক অন্য আলাদা তৃপ্তি পায় এই দীঘির পাড়ে এসে। ওদের গ্রামের সুমন ভুবনরা বেশ খাবারের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে ওখানে চাঁদের মত গ্রামের মানুষেরা এরকম ছোটখাটো খাবারের দোকান তৈরি করেছে যা থেকে তারা উপার্জন করে নিচ্ছে কিছু অর্থ তা দিয়ে তাদের সংসারটা দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারছে ছেলেমেয়েগুলো গ্রামের পাঠশালায় ভালো পড়তে পারছে এ সবই যেন ওই গোল দিঘিকে দিকে কে কেন্দ্র করে । তাই হাসানদের গ্রামের মানুষেরা গোল দিঘি কে খুবই যত্নে আঁকড়ে ধরে রাখে। সবুজ শ্যামল আয় গড়ে ওঠা গোল দিঘি তাদের কাছে যেন হয়ে উঠেছে মা কোথাও যেন হয়ে উঠেছে আর্থিক স্বচ্ছলতার এক প্রতীক। সত্যি গোল দিঘি এক অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী করে আর সেখানকার মানুষদের সাহায্য করে যাচ্ছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য তা আর গোলদিঘির অদ্ভুত পরিচয় মানুষকে ডেকে আনছে তার বুকে। এইভাবে গোল দিঘি আজীবন ওদের সাহায্য করে আসছে। সূর্যের উজ্জ্বল দীপ্ত রাশির মত গোল দিঘীরপাড় পরিবেশ মহামায়া দৃশ্য যেন বৈচিত্র্যে ফুটে উঠছে। এইভাবে গোল দিঘিতার বৈচিত্র্য দিয়ে মানুষকে টানছে আর হাসানদের গ্রামের মানুষগুলিকে আজীবন ধরে বাঁচিয়ে চলেছে।
হালচাল
হামিদুল ইসলাম
নদীর তীরে উদ্বাস্তু শিবির
এক ঘর
ছোট্টো কুটরি
এক একটি পরিবার
বাস করে ওরা জনম জনম ।
লজ্জার বালাই নেই
বাবা মা স্ত্রী পুত্র
একঘরে প্রতিদিন সহবাস
মানুষ তো ওরা নয়
মানুষের মতো কেবল অবয়ব ।
রাস্তায় মিছিল
মিছিলে পা রাখে ওরা
প্রতিবাদ জানায়
আগুন বাজার
আগুনে পুড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ।
অবশেষে পুলিশের লাঠিচার্জ
মাথা ফাটে অনেকের
রক্তে রাজপথ লাল
পুলিশ কেস ঠোকে ওদের উপরেই
এই দেশের এই হালচাল ।
কবিতা : অস্থিরতা !
বিশ্বজিৎ কর
এখনও কথা হয়,অতীতের সাথে!
প্রসারিত দৃষ্টির অন্তরঙ্গতায়,
কিশোর-প্রেমের আকুলতা!
একটু দেখার চপলতা,
মান-অভিমানের কবিতা!
বর্তমান হিসাব কষে জীবনখাতার প্রতি পাতায়!
অপ্রাপ্তি ফুলে ফেঁপে ওঠে-
ভবিষ্যত যায় না দেখা,
অনিশ্চিত বাতাবরণে!
সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিতে আশংকার পুঞ্জীভূত কালো মেঘ!
জীবন দোলে "আর এন টেগোর"-এর অঙ্গুলি হেলনে!
বিভাগ :--ধারাবাহিক প্রবন্ধ
কবিতা র রূপকল্প --- প্রথম পর্ব
সৌম্য ঘোষ
সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কবিতা সবচেয়ে প্রাচীন ।এটা সব দেশেই ।ছন্দোবদ্ধ কবিতা উচ্চারণ সবচেয়ে আগে আবির্ভূত হল কেন, তা বলা মুশকিল। জগৎ সৃষ্টির মধ্যে যে অন্তর্লীন ছন্দ রয়েছে ,তারই প্রেরণা কি কবিতার ছন্দবদ্ধ আত্মপ্রকাশ? ছন্দহীন জীবন ছন্নছাড়া । বিশ্বচরাচরের, মানব অস্তিত্বের এক অন্তর্লীন ছন্দের অনিবার্যতায় হয়তো কবিতার জন্ম । রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেছেন, " শিল্পানি শংসন্তি দেবশিল্পানি " । মানুষের সব শিল্প ই দেবশিল্পের স্তবগান করেছে। হয়তো আবেগের তীব্রতা থেকে কবিতা জন্মায়, আর সেই আবেগ তীব্রতা কল্পনায় প্রকাশ পায় ।
যা ছন্দময় তাই সব সময় কবিতা হয়না। আদিপর্বের সব রচনায় ছন্দময়তা ছিল । কিন্তু সব রচনায় কবিতা ছিল না। নিয়মিত ছন্দে বিন্যস্ত ছিল বলে সেই সব রচনাকে পদ্য বলা যায়। পদ্য রূপকল্পের ব্যাপার , আর কবিতা মূল্যবোধের ব্যাপার। তবে কবিতার ইতিহাস পদ্য থেকে কবিতার দিকে যাত্রার ইতিহাস। চর্যাপদের সব রচনা ছন্দবদ্ধ সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই । কিন্তু চর্যাপদের সব রচনা কবিতা হিসেবে গণ্য নয় । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ছন্দবদ্ধ দীর্ঘ কাব্যে নাটক আছে বটে কিন্তু কবিতা তত সুলভ নয় । রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ, চৈতন্যজীবনী ,মঙ্গলকাব্য প্রধানত পদ্য রচনা । এই কালপর্বে গদ্যের উন্মেষ হয়নি বলে পদ্যকে গদ্যের সব কাজ করে যেতে হয়েছে । আর সেইসব পদ্যকে আমরা কবিতা ভেবে ভুল করেছি। বিশুদ্ধ কবিতার দুর্লভ প্রকাশ মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলীতে পাওয়া যায়। কবিতার বিশুদ্ধতার সন্ধান আমাদের নিয়ে যেতে চায় কলাকৈবল্যবাদের দিকে । গীতিকবিতাই একমাত্র কবিতা নয় ।কবিতা হতে পারে হরেক রকম --------- মহাকাব্য ,আখ্যানকাব্য, নাট্যকাব্য ,রূপককাব্য, লোককাব্য ইত্যাদি ইত্যাদি । দার্শনিক উপলব্ধি, সামাজিক প্রসঙ্গ ,জীবন যাপনের গদ্যময়তা -----এসব কবিতার অঙ্গনের উপাদান । কবিতার উপাদান উঠে আসতে পারে জীবনের কর্কশ, মধুর, গভীর যে কোন উৎস থেকে। যেকোন পারিপার্শ্ব থেকে । কিন্তু সকল উপাদানের মৌলিক রূপান্তর হতে হবে কবিতায় । যেমন, পদার্থের চেতনায় । কাব্যগুণ না থাকলে তা কবিতা হতে পারে না।
কবিতায় যে সত্য বিধৃত হয় তা মনস্তাত্ত্বিক সত্য । কবি বহিরিন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় দিয়ে জগতকে দেখেন। তাই কবিদ্রষ্টার অনুভূতি ও কল্পনা দ্বারা বস্তুবিশ্বের যে রূপান্তর ঘটে সেই রূপান্তরিত সত্যকে কবিতায় রূপান্তরিত করে। কবির উক্তি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নয়, কবির উক্তি "pseudo- statement" ; কবিতা পাঠের সময় পাঠকের মনে অবিশ্বাসের সন্দেহ অপনোদন হয় কিন্তু কবির কথাই সত্য । তাই নিরীশ্বরবাদী কাছেও " গীতাঞ্জলি" সত্য হয়ে উঠতে পারে ।
প্রশ্ন হচ্ছে ,কবিতার ভাষা কেমন হবে? কবিতার ভাষা কি heightened language হতে হবে? কবিতার ইতিহাসের আবহমানতা পড়ে আমরা জেনেছি , দীর্ঘকালব্যাপী মানুষের মুখের ভাষা এবং কবিতার ভাষা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র। পরবর্তীকালে মিল্টন বা মধুসূদন দত্তের কবিতার ভাষা মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি চলে আসে । যেমন, ওয়ার্ডসোয়ার্থ বলেছিলেন কবিতার ভাষা হবে , " language really used by men". মুখের ভাষাই হবে কবিতার ভাষা। কিন্তু সে ভাষায় থাকবে কল্পনার বর্ণ সুষমা। সমসময়ের ভাষা হবে কবিতার ভাষা। কিন্তু হুবহু নয় । তাহলে কবি কালের মধ্যে বন্দি হয়ে যাবেন ।কবি সবসময়ই অতিসাময়িক ।তাই তাকে যেতে হয় ভাষাগত অসীমতায় ।
পদ্য, কবিতা নয় । ছন্দোবদ্ধ রচনা কে পদ্য বলে শনাক্ত করা হয় । কবিতার শব্দেরই বিন্যাস । সেই শব্দের তিনটি গুণ থাকে । যথা, ----- অর্থগুন, চিত্রগুন ও ধ্বনি গুন । শব্দ যখন কেবল অর্থময় তখন তা সংবাদ পরিবেশন করে মাত্র। যথা,
"দেশে খাজনার তরে পালাইয়া যাই ।
বিদেশে বেগারী বুঝি ধরিল সিপাই ।।"
এটি পদ্য, কবিতা নয় । কবিতায় থাকে দ্ব্যর্থতা। কবিতার শব্দ শুধু অর্থময় নয় ,তা চিত্রময় ও সঙ্গীতময়। যথা ,
"রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল ।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল ।।" (জ্ঞানদাস)
" মনে পড়ে কবে একরাত্রির স্বপ্নের ভিতরে
শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী
কেমন আশ্চর্য গান গায়
বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা
বাজায় ......". ( জীবনানন্দ দাশ )
এখানে আমাদের মানসপটে একটি ছবি উদ্ভাসিত হয় । উপমা ,উৎপ্রেক্ষা ,বাকপ্রতিমা বা চিত্রকল্প ছবি ফুটিয়ে তোলে কবিতায়। কবিতা হল ধ্বনিগত ঐশ্বর্য্যের। শব্দ সংগীতের।
কিন্তু শুধু অর্থ নয়, চিত্র নয়, ধ্বনি নয়, আরো এক অনন্য বিস্ময় কবিতাকে শিখরে আরোহণ করায় । এক অতল স্পর্শী নীরবতার গভীর থেকে কবিতার শব্দ গুলি তুলে আনেন কবি। শব্দের অমর বিন্যাসে সৃষ্টি হয় কবিতা । যেমন ,
" ফুলগুলি যেন কথা
পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার
পুঞ্জিত নীরবতা । "
নীরবতা থেকে উঠে এসে কবিতার কথা শেষ পর্যন্ত আরো এক নীরবতা দিকে ইঙ্গিত করে। কবিতার শব্দ ধাবিত হয় শেষহীন নীরবতার দিকে । অনুরণনের শেষে স্তব্ধতার দিকে । মহৎ কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সৃজনশীল স্বজ্ঞার দিকে, এক পরম দিব্যানুভূতির দিকে।
সেই বারো টাকা
সাফরিদ সেখ
ও দাদা এর দাম কতো?
নেবে বলো কেজি কতো?
আমাকে এক কেজি দিন।
এক কেজি?একটু বেশি নেন।
না,আমাকে এক কেজি দেন।
আচ্ছা বেশ ।দশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা দিন।
না না বারো টাকা দিন আমি ঠিক করে দিলাম।
টাকা দিতে গিয়ে তার চোখে জল,
কি হলো কাঁদছেন কেনো আপনি?
তত ক্ষণে চোখের জল গাল বেয়ে নামছে,
না!কিছু নয়,কই কাঁদিনি তো?
হায়রে! এই বারো টাকায় আমি তাকে
দিতে পারিনি,সে বারো টাকার জন্য সারারাত কেঁদেছিল।
বাবা হয়ে আমি আজ বুঝলাম সেই মেয়েটির ব্যথা
সে হয়তো আর কোনোদিন বারো টাকা চাইবে না।
কতো বারো টাকার আজ আমি মালিক
কিন্তু সেই বারো টাকা আমি কখনোই পাবো না।
সোনার মাদিনা
জুয়েল রূহানী
দাও প্রভূ দাও শক্তি আমায়-
যাবো মদীনায়,
দরূদ সালাম পড়বো, যেথা-
নবিজি ঘুমায়।
তোমার কাবা করবো তাওয়াফ
করবো মোনাজাত,
তোমার ঘরের পবিত্রতায়-
দিও যে, নাজাত।
তোমার কাবা ঘরের পাশে
মরন দিও প্রভূ,
মরন কালে কালিমা যেন-
ভূলি নাকো কভূ।
কবিতা
কাঁচের আয়না
মিনতি গোস্বামী
আয়নার সামনে দাঁড়ালে
এখনো মনে হয়
ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে
তুমি ঠিক করে দিচ্ছো আমার খোঁপা।
আবেশে চোখ বন্ধ করলেই
জলে ভরে ওঠে চোখ
পেরিয়ে গেছে পঁচিশ বছর
ফুরিয়ে গেছে সব কথা।
স্বপ্নে যেটুকু দেখা
সেখানে ও শুধু ছায়া
কথাহীন দুজনেই বোবা
ঘুমের ঘোরেই ভেঙে ফেলি
কাঁচের আয়না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী জন্মপূর্তি উপলক্ষ্যে উনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি কবিতা---
বিদ্যাসাগর
জহরলাল দাস
বিদ্যাসাগর তুমি সাহিত্যের গুরু
বাংলাসাহিত্যের পথচলা তোমার হাতেই শুরু।কথামালা,আদর্শলিপি,বর্ণপরিচয়
এগুলি আজও বাংলা সাহিত্যের সম্পদ অক্ষয়।
কঠিন কঠোর গদ্যকে তুমি দিয়েছো শিল্পের সুষমা,
তোমার হাতেই যতিচিহ্নের ব্যবহার;নাই যার উপমা।
মানবতাবাদী তুমি করুনার সাগর
এই সংসারে তোমার সবাই আপন;কেহ নয় পর।
"বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পী তুমি"-কবি গুরুর বানী,
সমাজ-শিক্ষা সংস্কারে তোমার অবদান আমরা সবাই জানি।
বহুবিবাহ,বাল্য বিবাহের কুফল লিখে দিয়েছো চেতনা
বিধবাদের দুঃখ মোচনের তোমার নাহি তুলনা।
মানবতাবাদী তুমি মোদের স্বজন,
বাঙালি তথা ভারতবাসীর হৃদয়ে থাকবে বেঁচে আজীবন।
অসীমের পানে ভালোবাসার আস্পৃহা
এমাজদ্দিন সেখ
তোমার আমার ভাবের খেলা, ভব মেলায় কেউ বুঝলো না !
চাওয়া পাওয়া'র ক্ষুদ্র মন নিয়ে কেউ সেই ভাবেতে মজবে না l
স্বতন্ত্রতার খোলা আকাশ , অন্তরেতে দৃঢ় স্বর্ণ মার্গ ; ....
তব হৃদয় রসের প্রশান্ত জলে, হৃদৈশ্বর্য্য সবই করেছি উজাড় ; ...
আদর্শ - স্রোতে বিলীন প্রাণ , ডুব দিয়ে কেউ দেখল না ; ....
চাওয়া পাওয়া'র ক্ষুদ্র মন নিয়ে কেউ সেই ভাবেতে মজবে না l
ভবে দুই মেরুর ব্যবধান, মনৈশ্বর্য্যে মন মিলিয়ে তোমায় সোঁপেছি মন ;...
ভিন্ন স্বত্ত্বা, মুক্ত মন , চিন্তা মিলে খোলা আকাশ ; সেথায় কেহ খুঁজল না ; ...
চাওয়া পাওয়া'র ক্ষুদ্র মন নিয়ে কেউ সেই ভাবেতে মজবে না l
বোকা , পাগল বলে বন্ধু - স্বজন , তবু মোরা সমান্তরাল ; ...
দোঁহার মন ,এক ঠিকানা , প্রেম সাধনার এ গূঢ় চেতনা !
বিরহ মাঝে মহামিলন , মিষ্টি যাতনা ফুরিয়ে যাবার নেই ভাবনা ; ...
চাওয়া পাওয়ার ক্ষুদ্র মন নিয়ে কেউ সেই ভাবেতে মজবে না l
সেই ভোরে আজও
অঞ্জলি দে নন্দী, মম
রোজ ভোরে তুমি সিক্ত কেশে শুদ্ধ বস্ত্রে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে কিছুটা হেঁটে তোমাদের বাস্তু মহাদেবের শিরে জল ঢালতে আসতে। মন্দিরের পিছনের খিড়কি ঘাট থেকে তোমার রজত ঘটটি ভরে জল নিয়ে, আশেপাশের গাছ থেকে কলকে, ধুতর ও বেলপাতা তুলে ঢুকতে শিবের ঘরের দরজার শেকল খুলে। জল ঢেলে, চন্দন ঘষে তা দেবকে পড়িয়ে, পাতা ও ফুল দিয়ে পুজো করতে। আঁচল থেকে গিঁট খুলে লিঙ্গের পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা রজত রেকাবিটি পেতে তাতে পাঁচটি গুড়ের বাতাসা দিতে। হাঁটু গেড়ে বসে মন্ত্র বলতে চোখ বুজে। এরপর মাথা ঠুকে প্রণাম করে দরজা বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে। রোজ সেই সময় আমি দূর থেকে তোমায় চোখ ভরে দেখতাম। আমি ঐ ভোরের শুকতারা। সেই ভোরে আজও আমি তোমাকে খুঁজি। জানি না কোথায় হারিয়ে গেলে......
উপকণ্ঠ প্রাত্যহিক ওয়েব ম্যাগাজিন- 21/09/2020
খুব সুন্দর। দারুণ উদ্যোগ
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
মুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
মুছুন