নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীঃ বিখ্যাত আধুনিক বাংলা কবি
বিপ্লব গোস্বামী
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত বিখ্যাত আধুনিক ভারতীয় বাংলা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী ও স্বদেশপ্রেমী কবি।তিনি ঘৃণা করতেন মেকি দেশপ্রেমকে।তাঁর কবিতার ভাষা আধুনিক কবিদের মতো দুর্বোধ্য না হলেও গভীরতা খুব বেশি।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ১৯৪২ সালের ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশের ফরিদপুরের চন্দ্রগ্ৰামে জন্ম গ্ৰহণ করেন।তাঁর পিতা জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন একজন ইংরেজে ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক।আর মাতা প্রফুল্লনলিনী চক্রবর্তী ছিলেন একজন পরিপূর্ণ গৃহবধূ।কবির পিতার কর্মস্থল ছিল কলকাতায়।তাই মাত্র দু বছর বয়সে কবিকে তাঁর ঠাকুরদাদা লোকনাথ চক্রবর্তীর কাছে রেখে কলকাতায় চলে আসেন তাঁর মা বাবা।ঠাকুরদাদার কাছে গ্ৰামবাংলার প্রকৃতিক পরিবেশ আর কাদা-মাটিতে বড় হয়ে উঠেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।খুব আনন্দে কাটছিল তাঁর শৈশব।শৈশবেই পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রতিভার।মাত্র চার বছর বয়েসেই তিনি মুখস্থ করেছিলেন রামায়ণ গান ও কবিগান।
কবির প্রাথমিক শিক্ষা শুরু গ্ৰামের পাঠশালাতেই।তারপর ঠাকুরদার মৃত্যুর পর ১৯৩০ সালে কলকাতায় চলে আসেন তিনি।কলকাতায় এসে প্রথমে বঙ্গবাসী স্কুলে এবং পরে মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯৪২ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন নীরেন্দ্রনাথ।তারপর ১৯৪৪ সালে সেন্ট পলস্ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে বি. এ পাশ করেন তিনি।
কর্ম জীবনে নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।"দৈনিক প্রত্যহ" পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি।"সত্যযুগ" পত্রিকায় সাংবাদিক রূপে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।তারপর তিনি কাজ করেছেন মাতৃভূমি,ভারত,স্বরাজ,ইউনাইটেড প্রেস অফ ইণ্ডিয়া,প্রভৃতি পত্রিকায়।১৯৫১ সালে তিনি যোগ দেন আনন্দবাজার পত্রিকায়।আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি সম্পাদকীয় নিবন্ধিকার হিসাবে কাজ করেছেন।১৯৭৬ সালে তিনি "শিশু কিশোর" পত্রিকার আনন্দমেলার সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন।
সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগটা সেই ছোটবেলা থেকেই।মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে "শ্রীহর্ষ" পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্য জগতে তাঁর আত্ম প্রকাশ ঘটে।তাঁর প্রথম কাব্যগ্ৰন্থ "নীল নির্জন" , প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে।এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্ৰন্থ অন্ধকার বারান্দা,নীরক্ত করবী,নক্ষত্র জয়ের জন্য,আজ সকালে,উলঙ্গ রাজা,ভালোবাসা মন্দবাসা প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্যগ্ৰন্থ।এসবে মধ্যে "উলঙ্গ রাজা" তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্ৰন্থ।'পৃর্তিপুরুষ" তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ,প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।তাঁর লেখা আত্মজীবনী মূলক গ্ৰন্থ "নীরবিন্দু-১" প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে।১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা কাব্যনাট্য "প্রথম নায়ক"।এছাড়াও তিনি লিখেছেন অনেক ভ্রমণকাহিনী,রহস্যকাহিনী ও ছোটদের ছড়া-কবিতা।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রয়েছে তাঁর অনন্য অবদান।সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ভঙ্গবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করে।ঠিক একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট ডিগ্ৰি প্রদান করে।১৯৭৪ সালে তাঁর "উলঙ্গ রাজা" কাব্যগ্ৰন্থের জন্য লাভ করেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।এছাড়া তিনি ১৯৭০ সালে তারা শঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৭৬ সালে তিনি আনন্দ শিরোমণি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ২০১০ সালে লাভ করেন বিদ্যাসাগর পুরস্কার।
দীর্ঘ দিন বার্ধক্য জনিত রোগে ভুগে ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।বাংলা সাহিত্য তাঁর অনন্য অবদান অবিস্মরণীয়।তিনি আজও জীবিত হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।তাঁর অনন্য সৃষ্টি আজও পাঠকমহলে সমাদৃত।
0 comments: