রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০

উপকণ্ঠ প্রাত্যহিক ওয়েব ম্যাগাজিন- 11/10/2020

 উপকণ্ঠ প্রাত্যহিক ওয়েব ম্যাগাজিন- 11/10/2020
Upokontha sahitya patrika Web Megazine- 11/102020


|| কবিতার রূপকল্প : পর্ব : ১৯ ||

     ||  রবীন্দ্র পরবর্তীকাল  এবং আধুনিক কবিতার  আন্দোলন ||
            ( চতুর্থ অংশ )
             সৌম্য ঘোষ


            এই পর্বে কবিতার রূপকল্প আলোচনা করার পূর্বে সেই সময়কার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা জরুরি । তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি এবং অবশ্যই আমাদের দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস অনুধাবন না করলে , কবিতার আবহমানতাকে ধরা সম্ভব না ।
          ১৯৩৬ সালে শুরু হয় স্পেনের গৃহযুদ্ধ, ১৯৩৭ সালে জাপান আক্রমণ করে চীন দেশ । অতঃপর শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ । ১৯৪১ সালে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে । সারা বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী মানুষের ফ্রন্ট গঠিত হয় । আমাদের দেশের ভিতরেও পরিস্থিতি ছিল অগ্নিগর্ভ । চল্লিশের দশকে সারা ভারতবর্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ( অখন্ড বাংলা) উত্তাল হয়ে ওঠে । রাজনৈতিক বিক্ষোভ আলোড়িত করে সমস্ত দেশকে। প্রতিরোধ রচনায়  একত্র হয়ে ছিলেন রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে সংস্কৃতিকর্মীরাও । এই দশকে গান্ধীজীর ভারতছাড়ো আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তি আন্দোলন, নৌসেনার বিদ্রোহ, 'ডাক ও তার' কর্মীদের হরতাল  । চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছানো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম । সেই সময় ইংরেজ শাসকবর্গের চরম ঔদাসীন্যে ও হৃদয়হীনতা পঞ্চাশের মহামন্বন্তর  এবং ইংরেজ শাসকদের প্ররোচনায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা । এই শতকের শেষে দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এলো । পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু স্রোত এসে আছড়ে পড়লো এই দেশে।
                    সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তাঁর আত্মজীবনীতে , তৎকালীন সময়ের ভয়াবহতা কিছুটা বর্ণনা করেছেন । স্বাধীনতা লাভের পর হিন্দু-মুসলিম-শিখ-পাঠানদের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী ভয়ঙ্কর সংঘাত হয়েছিল, তাতে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন হানি হয় । প্রাণ রক্ষার প্রবল আকাঙ্ক্ষা সৃষ্ট বাস্তুত্যাগে জনতার বিশাল কাফেলাকে তিনি মানুষের হিমবাহ রূপে বর্ণনা করেছেন ।
                    সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে রাষ্ট্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সেই সময় কম্যুনিস্ট পার্টি বিপ্লবের  সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শুরু হয় তেভাগা আন্দোলন। এই সমগ্র পরিস্থিতি চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো । শিল্পকলার সাহিত্যের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা গ্রহণ করার চেষ্টা করে । এর সমর্থক ছিলেন ফরাসি কবি লুই
আরাগঁ  ।  শিল্প-কলা-সাহিত্যে রাজনৈতিক পার্টির
হস্তক্ষেপ  বুদ্ধদেব বসু , বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র মেনে নেননি।  এই সময়ের অভিঘাতে বদলে যায় বিষ্ণু  দের কবিতা , বুদ্ধদেব বসুর মতো কলাকৈবল্যবাদী কবিও লিখলেন :
"বৃহন্নলা, ছিন্ন করো ছদ্মবেশ ।"

                          প্রগতিপন্থী ।
                          প্রগতিপন্থী এই কবি গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রণী ছিলেন সমর সেন (১৯১৬--৮৭) এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-- ২০০৩) । কবি সমর সেন তাঁর আঠারো বছর বয়স থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত মাত্র বারো বছর কবিতা লিখেছিলেন। প্রথম দিকে তিনি আধুনিক সভ্যতার বন্ধ্যাত্ব ও শূন্যতার কবি ছিলেন।
" শ্রান্ত হয়ে এলো অগণিত কত প্রহরের ক্রন্দন
    তবু আমার রক্তে খালি তোমার সুর বাজে ।"
তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মনে পড়ে এলিয়টের পদগুচ্ছ " waste and void " . তাঁর কবিতার ছন্দে আমরা পাই , " চীনের গণিকা, মাতালের স্খলিত চিৎকার, লম্পটের পদধ্বনি, রেস্তোহীন
গুলিখোর , চিৎপুরের ঘাটের নারীদলের কথা । বাংলা গদ্যছন্দে তিনি অনবদ্য। তাঁর কবিতা নির্মেদ
নির্ভার , সরল ভাষা , কিন্তু একেবারে স্বকীয় । তিনি মনে করতেন, বিস্তীর্ণ নগরে যে আধুনিক সভ্যতার প্রতীক তার অবক্ষয় ও আসন্ন বিনাশ অবশ্যম্ভাবী । লিখলেন, " আমাদের মৃত্যু হবে পান্ডুর মত । " পান্ডুর অসংযত যৌনাচার এবং ধৃতরাষ্ট্রের সজ্ঞান অন্ধতা ।

"তাই ঘরে বসে সর্বনাশের সমস্ত ইতিহাস
  অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো বিচলিত শুনি,
  আর ব্যর্থ বিলাপের বিকারে বলি :
   আমাদের মুক্তি নেই , আমাদের জয়াশা নেই ।"

তাঁর চিত্রকল্প গুলি অসামান্য :

----- " চাঁদ ওঠে জ্বলন্ত খড়্গের মত"।
-----  "এখানে সন্ধ্যা নামল শীতের শকুনের মতো"।
-----   "বন্য মহিষের আক্রোশে জগদ্দল মেঘ
          ঘন ঘন ডাকে ।"
-----  "উজ্জ্বল, ক্ষুধিত জাগুয়ার যেন
          এপ্রিলের বসন্ত আজ ।"

তিনি মনে করতেন, অনুর্বর সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য, এবং তার ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্ম নেবে নতুন সভ্যতা ।
"কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী
   যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে ।"
সাহিত্য সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক মতবাদের উগ্ৰ হস্তক্ষেপ তিনি পরবর্তীকালে মেনে নিতে পারছিলেন না । বরং তাঁর মনে হচ্ছিল , ব্যক্তিগত সততা বজায় রাখার মধ্য দিয়েই কবি হতে পারেন প্রগতিশীল ।  ফলে নিজের রাজনৈতিক দলের সহকর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন । ব্যথিত কবি স্তব্ধ হয়ে গেলেন :
          " শুনি না আর সমুদ্রের গান
       থেমেছে রক্তে ট্রামের বাসের বেতাল স্পন্দন
      ভুলে গেছি সাঁওতাল পরগনার লালমাটি...
    রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় কবিতায় "

                   সুভাষ মুখোপাধ্যায়
               ----------------------------------
                  সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতার বই "পদাতিক" নিয়ে আবির্ভূত হয়ে সাড়া ফেলে দিলেন। আর তিনি প্রথম থেকেই রাজনীতিকে করে নিলেন কবিতার বিষয়। সেই সময় রাজনীতিকে কবিতার বিষয় করা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুসহ অন্যান্যদের দ্বিধা ছিল, কিন্তু শৈল্য কুশলী সুভাষ পেয়েছিলেন অকুণ্ঠ অভ্যর্থনা । তাঁর এই সব কবিতায় ছিল ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারুণ্যের উদ্দীপনা ।
         "প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
           ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ।"
চল্লিশ দশকে শুরু হলো কবিতার শেষ চরণে আশাবাদী সার কথা বলা। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা  " মিছিলের মুখ ।"
          "বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র
           আগুনের শিখার মত হাওয়ায় কম্পমান।
           তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই মুখ
            নিষ্কোষিত তরবারির মত .....।"
এই কবিতায় প্রেম ও রাজনীতির অনবদ্য একাত্মতা।
                       অমরুশতক , হাফেজ, চর্যাপদ, গাঁথাসপ্তশতী থেকে শুরু করে সারা জীবন অনেক কবির কবিতা তরজমা করেছেন । তবে সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয়েছিলেন তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের কবিতা অনুবাদ করে। এরপরই তিনি লিখলেন "ফুল ফুটুক " কবিতা গুচ্ছ । তাঁর জনপ্রিয় কবিতার স্তবক "ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত" । এই কবিতাগুচ্ছে আছে শহরতলীর চটকল কেন্দ্রিক বস্তি জীবনের সব চিত্রকল্প।একসময় যিনি ফুল খেলা নিয়ে বিদ্রুপ করেছিলেন তিনি পরবর্তীকালে সন্ধ্যামণি ফুল ফোটাবার কথা বললেন।   তাঁর " কাল মধুমাস" আত্মজৈবনিক কবিতা যেখানে ফিরে আসে হারানো সব স্মৃতি।
"পদাতিক কবি" সুভাষ মুখোপাধ্যায় আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে জীবনের কথা লিখে গেছেন। তিনি জানতেন, " নটেগাছ মুড়োলেও বীজ থেকে জন্ম দেবে মাটি ।"

       পদাতিক কবির স্মরনীয় কবিতা :

  " শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না –
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয়, হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।"

কবিতা -- ' বায়ে চলো ভাই , বায়ে চলো'

"বাঁয়ে চলো ভাই,
বাঁয়ে—
কালো রাত্রির বুক চিরে,
চলো
দুহাতে উপড়ে আনি
আমাদেরই লাল রক্তে রঙিন সকাল"।

               অরুণ মিত্র । কবি অরুণ মিত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সমসাময়িক বটে, কিন্তু তিনি সুভাসের মত নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না । কবি হিসেবে তিনি একেবারেই স্বতন্ত্র। তিনি অনুভব করেছিলেন, শিল্পসাহিত্য সৃজন একক সাধনার বস্তু ।  ' প্রান্তরেখা' কবিতার পর , তাঁর লেখা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । এরপর তিনি ফ্রান্সে চলে যান । ফরাসি কবিতার সঙ্গে পরিচয় তাঁকে আপন পথে এগোতে আত্মবিশ্বাস যোগায় ।
ধ্যানলীন অরুণ মিত্রের কবিতা । স্বগতোক্তর  মত অন্তর্লীন কবিতা রচনা আদর্শ তিনি প্রধানত অর্জন করেছেন  স্যাঁ ঝন্ , পেরসে , পোল এলুয়ার  প্রভৃতির কাছ থেকে । তাঁর অসামান্য স্তবক--
" সমস্ত লাবণ্য শব্দেই ছেঁকে তোলা যাবে "
  " আমি বাক্য দিয়ে আমার প্রেম প্রমাণ করেছি"

             কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
            ________________________

                  ২০২০ সাল কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী । আজীবন আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি যে কত প্রাসঙ্গিক, আজও তা তাঁর কবিতা পড়লেই বোঝা যায় । তাঁর সমস্ত উচ্চারণ, শব্দগুলির জন্ম যেন উঁচু  ঘাড় , ফোলানো শিরা , আর উঁচু পর্দা থেকে । কিন্তু তা বিশুদ্ধ কাব্যগুনে পুষ্ট । সমস্ত অসাম্যের বিরুদ্ধে, সমস্ত লাঞ্ছনার বিপরীতে তাঁর প্রচন্ড রণহুঙ্কার ধ্বনিত হয় । দেশভাগ, পার্টি ভাগ, খাদ্য আন্দোলন থেকে শুরু করে নকশালবাড়ি আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, বন্দী মুক্তি আন্দোলন -------- তাঁর লড়াই,  তাঁর সংগ্রাম। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত মন- মেজাজ- মানসিকতাকে চাবকে শাসনের পর বিধ্বস্ত দেহে তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত রক্তমাখা শব্দ---- একটি নির্মল প্রেমের কবিতা ।
                    
                         ঢাকাই টানে বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। কবিতা মাথায় এলে হাতের কাছে যা পেতেন------ তাতেই লিখে রাখতেন। এই ভাবেই একদিন লিখলেন কালজয়ী কবিতা :

"মাটি তো আগুনের মতো হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি ।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।"

সরল সাদাসিধে জীবনযাপনে, নিজের আদর্শ, স্বাধীনতা ও সততার প্রতি দায়বদ্ধতায় অন্য কারো সঙ্গে যাঁর মেলেনা । তাই তাঁকে রাখা হয় , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশে। দেশভাগ তাঁকে আলোড়িত করেছিলো :

"আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারিনা ।"

মুখোশ পরা মানুষ দেখতে দেখতে ক্লান্ত কবি লিখলেন :
"আসলে মুখোশ মোটেই বাইরের নয়। বরং ভিতরের
যাকে আমরা সত্তিকারের মুখ ভাবি
তেমন কিছুই মানুষের নেই।"
তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ ছিল প্রখর। বলতেন, "কবি যত শক্তিমান ই  হন , তাকে ভালো মানুষও হতে হবে ।" একজন প্রকৃত বামপন্থী কম্যুনিস্ট । তাঁর উচ্চারণ স্লোগান হয়েও কবিতা , সোচ্চার হয়ে ওঠা মন্ত্র ;  কবিতার মন্ত্র :

"অন্ন বাক্য, অন্ন প্রাণ
অন্নই  চেতনা
অন্ন ধ্বনি, অন্ন মন্ত্র ,অন্ন আরাধনা ।"
স্বদেশের প্রতি তাঁর গভীর মমতা ঝড়ে পড়তো :

"তোর কি কোন তুলনা হয়?
তুই ঘুমের মধ্যে জলভরা মেঘ,
জাগরণে জন্মভূমির মাটি ।"
    
                    সুকান্ত ভট্টাচার্য
                  --------------------------

                    দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ , মহামন্বন্তর , হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রক্ত কলুষিত দিনগুলিতে যাত্রা শুরু করলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ( ১৯২৬--৪৭) ।  আত্মপরিচয় দিয়ে তিনি লিখলেন, "আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,/ প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ।" দেশ যখন সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল, তখন সুকান্তর কবিতায় পেলাম পরাধীনতার বেদনা :

"এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,
অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম।"
তাঁর দ্যুতিময় ছত্র :

"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়;
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ।"

ইংরেজ কবি অডেনের "Night Mail" কবিতা থেকে বীজ এসে অঙ্কুরিত হলো সুকান্তর " রানার " ।

                     প্রগতি আন্দোলন প্রভাবিত আরো কয়েকজন কবি হলেন, বিমল চন্দ্র ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সরোজ দত্ত, চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং দিনেশ দাস । বিমল চন্দ্র ঘোষ প্রথমদিকে কবিতা লিখলেও পরের দিকে তিনি বিখ্যাত গান রচনা করেছিলেন । যেমন,  " উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা " ,  " ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস " । কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র র কবিতায় বিষ্ণু দের প্রভাব স্পষ্ট । উত্তরকালে  বিখ্যাত  নকশালপন্থী নেতা কবি সরোজ দত্ত ।
                     চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায় । তাঁর তিনটি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।  চল্লিশ দশকের অন্যান্য স্বনামধন্য কবিরা হলেন ,  কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত, মনীন্দ্র রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, অসীম রায় প্রভৃতি ।  কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত র  মমতাময় আত্মস্থতা :

  " অংকুর থেকে আস্তে আস্তে ফুল
     সময় লাগে
      বীজ থেকে আস্তে আস্তে ধান
      সময় লাগে.... ‌।"
এই কবিতার ব্যপ্তি ও  রেশ  চেতনায় গেঁথে যায়।

                  কবি মনীন্দ্র রায় দক্ষতার সঙ্গে কবিতা রচনা করেছেন । তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় হল প্রবাহ কাল ।
" এই করতলে
   আয়ুর মতোই আমি কয়েকটি রেখায়
   বন্দি করে রেখেছি ত্রিকাল ।"

কি অসাধারণত্ব  !

                    কবি সিদ্ধেশ্বর সেন কবিতা লেখা শুরু করেন চল্লিশ দশকের কারফিউর রাতগুলিতে। তাঁর কবিতায় ভারতীয় ঐতিহ্য আত্মস্থ , শ্লোকের প্রতিধ্বনি । তিনি ধরতে চান কবিতায় চিরন্তন ধৈর্য :

" এই প্রাণময় গ্রহে , নৃত্যপর ঘুরণে, আহ্নিকে,
   মুক্তি চাই মানবতা , অবিচ্ছিন্ন সময়ের দিকে ।"






মিনতি গোস্বামীর দুটি কবিতা
(১)

অমলতাস

এখন
বন্ধু দেখি
মেতেছি আমি অমলতাসে
আর কোন ছন্দ নয়
নিঃসংকোচে নিজের ‌ মত ভাঙছি গড়ছি
নিজের ইচ্ছেকে  নিজেই করছি এখানে প্রকাশ।

প্রতিটি জীবনের নিজের কিছু থাকে আল
নিজের ময়দানে চিরকাল নিজেই লড়ছি
পাইনি কোনদিন অহেতুক ভয়
মরবোনা শমনের ত্রাসে
অমলতাস লিখি
যখন।

(২)

নীল সমুদ্র

আজ
সমুদ্র দেখছি
বড় বেশি নীল
ঢেউয়ের পরে জাগছে ঢেউ
মুছে দিচ্ছে বালিতে গড়া সম্পর্ক
ভুলিয়ে দিচ্ছে মনে জমে থাকা অহংকার।

বিশাল সমুদ্রতটে থাকেনা মানুষের ঘর বার
মানুষ ভুলে যায় লেনদেনের তর্ক
হারালে টুক করে কেউ
হয়তো হারাবে ঢিল
বালিতে লিখছি
লাজ ।





সকাল ন'টায় একলা কথন
         লুইস গ্লাক
    অনুবাদ = অনিন্দ্য পাল
============================
" এটা কোন ছোট ব্যপার নয়, সেটা আসছে
সঙ্গীতময় এই অনুচ্ছেদে। সজীব
তার অসুস্থতার শুরু থেকেই আছি
ষোল বছর আগে থেকেই, বসে আছি ষোলটা বছর এবং এগুলো ভালো হবার অপেক্ষা করছি।
আমাকে হাসতে হবে।
তুমি জানো, স্বপ্ন দেখি আমি মৃত্যুতে ডুবে যাওয়ার 
অথবা দেখি সে আবার অন্য কারো প্রেমে পড়েছে এবং তার সাথে রতিমগ্ন হয়েছে। বেশ, তেমনি হোক।
ভেবেছিলাম শূন্যতাটা অনুভব করেছি, এবং আজ
সে মৃত্যুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফেলে গেছে তার ডিমের পোচটা, তার টোস্ট এখনো তেমনি আছে ছোঁওয়া হয়নি একেবারে।"
==================================== 







নগর নাগিনী
        এমাজদ্দিন সেখ
 

তোমার নগরে সব আছে l
আছে  পরিসেবার আধুনিকতম  উপকরণটি ;
আছে যোগাযোগের  আধুনিকতম যান টি ;
আছে থিয়েটার ,  রেস্তোঁরা ....
বাইরে রাত কাটানোর  হাজার উপায় উপকরণ ...
প্রসাধনের  সম্ভার  বিবিধ  ...
আছে মনে আকাশ ভর্তি হিংসা ;
আছে মেকি হাসি ঠোঁটে বিষ ছুরি ;
আছে গ্রামের প্রতি তোমার কারখানার বর্জ্য সম অবজ্ঞা !!
আমার আছে গ্রাম l
গ্রামে আছে নাড়ির টান ;
আছে হৃদ্যতা  ;
আছে ভালোবাসা , লোক দেখানো নয় ;
অন্তরের গহীনে চলা চল ...
গ্রাম কাছে টানে , আপন করে   
কৃত্রিম  হাসির আড়ালে ঠোঁটে  গরল মাখা থাকে না ;
  থাকে স্নেহ অমৃত  শত ঝঞ্ঝায় বাঁচার সম্বল ;
প্রিয় জনে বাঁচতে শেখায় ;
দূর বাসির প্রেরণা যোগায় ...
গ্রামের মন আকাশ খোলা ,
তোমার ছাদটির মতো ক্ষুদ্র না  !
হে , নগর বিলাসিনী  তোমার  রেস্তোঁরার চব্য চোষ্য  গ্রাম থেকেই যায় !
অহঙে  বোঁদ থাকতে পার ;  থাকো ...
অবজ্ঞার  খোঁচা দিয়ে উস্কিয়ো না ll

  





কবিতাঃ
         মানবের ঠাই
                  জুয়েল রূহানী

মানব মহান মুখের কথায়
ভিতরে তার শয়তান রূপ,
মুখের বুলিতে কারবে মন
মুখোশ না করে উন্মোচন!

বুঝা বড় দায় মানব রূপ
সাধুর ভিতরে চোর নিশ্চুপ,
কখনও বা সাধারনে-
অসাধারন গুনের স্তুপ!

মানব মনে শয়তান কভূ
বসবাস করে ছলনায়,
মানবে ফুটিয়ে তোলে-
চিত্র নানান উন্মাদনায়!

মানব মনের ঠাই ফেরেশতায়
কখনও বা ঠাই শয়তানে,
মানবের ঠাই মানব মনে-
দোযক কিংবা স্বর্গপানে।




           মা
         কনিকা রায়

"মা "শব্দ টি অনেক ছোটো-

কিন্তু জীবনে" মা "শব্দের অর্থ অনেক বড়ো।
মা মানে  মস্ত আকাশ-
মা মানে  অফুরন্ত ভালোবাসা-
মা মানে  অগাধ বায়না।
মা মানে   মুখে না বলা কথাও এক নিমেষে বুঝে ফেলা,
মা মানে  অনুপ্রেরণা।

মা মানে  এক স্নেহের বালিশ-
মা মানে   হাজার  কষ্টেও এক সুখের চাবিকাঠি।

মা মানে  নিজে অভুক্ত থেকে
সন্তানের ক্ষুধা নিবারণ,
মা মানে  নিজের সমস্ত সখ সন্তানের উপর বিকিয়ে দেওয়া।
মা মানে  এক শীতল মমতা ,     মা মানে  এক গভীর ভালোবাসা।

মা মানে    অনেক কিছু ,
যা নোবেল প্রাইজ কিংবা অস্কারের চেয়েও অনেক বড়ো পাওয়া-

এক পরম নিশ্চিন্তি।








                     " বরাবর "
                হামিদুল ইসলাম
                  
হাতের মধ‍্যে ধরে রাখি জীবন
বিনয়ের হাত
কখনো অদৃশ‍্য
মৃত কঙ্কালগুলো ফিরে আসে অগ‍্যতা
ছায়ার মতো অনুসরণ করে আমার হাত   ।।

জীবন নিত‍্য নাটের খেলা
অসবর্ণ ইতিহাস
ভুলে যাই পথ
অন্ধকার
ছায়ারাই আমার নিত‍্য সঙ্গী  ।।

যবনিকার আড়ালে বজ্রপতন
ঈশ্বর সদা খোঁজেন মানুষ
পেয়ে যান কঙ্কাল
ছায়া ছায়া অন্ধকার
অবুঝ মন আলোয় ভাস্বর  ।।

কার জন‍্যে পথ চলি
মনের মাঝে জাগ্রত তার প্রতিবিম্ব
তাকে দেখি নি কোনোদিন
অথচ সে জেগে থাকে আমার অন্তরে
হাতছানি দেয় হৃদয় বরাবর  ।।





শরতের গান
            মোঃআলিউল হক

শরৎ এলোরে
শরৎ এলোরে
হিমেল হাওয়ায় খুশি ভ'রে।

কাদামাটির মূর্তি হাতে
শরৎ এলো দুই বাংলাতে
মা দুর্গা ঐ পথে পথে
মণ্ডপে মণ্ডপে সালাম করে।

দু্ঃখ বিভেদ এই সমাজে
থাকবে না আর,মা এলো যে
চৌদিকে তাই ঢোলক বাজে
মায়ের আশীষ ছড়িয়ে পড়ে।

পূজো পার্বন  ঐতিহ্য কে
রাখতে হবে বাংলার বুকে
লক্ষী সরস্বতীর আদর্শকে
বুকের মাঝে রাখবো ধ'রে।





হাওয়া বাতাস
     আব্দুল রাহাজ

হে হাওয়া বাতাস
তোমার  বাতাসে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য হেলিয়ে দুলিয়ে মাতিয়ে দেয়।
গ্রাম বাংলার পরিবেশকে দেয় অপরূপ  মায়া সৌন্দর্য।
সবুজায়নকে বিস্তৃত করে
এই সুন্দর পৃথিবী কে পরিণত করে রূপকথার দেশে।
আর গ্রামবাংলার পরিবেশকে পরিণত করে এক অপরূপ সৌন্দর্যের মায়াজাল।






চাঁদ মামা
         বিপ্লব গোস্বামী

চাঁদ মামা চাঁদ মামা
বলি যে তোমায় ;
লক্ষ নায় হাজার নয়
একটি তারা দাও গো আমায়।
কত লক্ষ-কোটি তারা
আছে তোমার কাছে ;
একটি তারা দিলে আমায়
তেমন কি আর যায় আসে ?
বড় কিপ্টে মামা তুমি
দান দেওয়ার তরে ;
কত তারা অমনি অমনি
রোজই খসে পড়ে।
আমি যদি চাই তবে
ভীষণ পিড়াপিড়ি ;
আজ হতে তোমার সনে
দিলাম আমি আড়ি।





     ও   মেয়ে
         পিনাকী   মুখার্জী
     
              সমুদ্র  মন্থনে  ওঠে
               অতি  তীব্র  বিষ !!
        লক্ষ্মী  তোমার  উদয়  থেকেই
               সাপের  হিস্  হিস্   !!

       ওগো  যাজ্ঞসেনী লালসার ঐ
                কৌরব  দরবার  !!
          সীতার  জন্য  পাতাল  কিম্বা
               চিতার   উপহার  !!

              মীরার  জন্য  বিষ  আর
                কলঙ্কিনী , রাধা একা  !!
            এক্স  ওয়াইয়ের  খেলায় তুমি
                 খেয়েছো  সদাই  ধোঁকা  !!
              
             সীতার  জন্য  তোমার  উমা
               অকাল  বোধন  লাগে !!
         অপমানের  কালিমা  ঘোচাও , নিজে
                  দুর্গা   হয়ে  জেগে  !!




সেই গাছ
        উমর ফারুক

সেই গাছ
আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি
একটু তোলা হলেই সমাজ তাকে
নির্দ্বিধায় মস্তক ছেদন করে ।
আবার কচি বাতাবি লেবুর মত
নরম পাতা  বের হলে কতকগুলি
তৃণভোজী মাথা মুড়িয়ে দেয়।
আবার যখন পাতা গজানোর সময় হল
ঠিক তখন আপনার আত্মার
শান্তি কামনা করে সে তার প্রভুকে ডাকে।
এমন এক রাক্ষস পুরি তে তার বাস
যেখানে কোনো ভাবেই তার নিরাপত্তা নেয়
মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী
এক ঝাঁক মানুষ ও  সময়।





কখনো কখনো
             সমীরণ বেরা

কখনো কখনো চুপ করে থাকতে হয়
কখনো কখনো থামতে হয়
এক নৈশব্দিক বিপ্লব ঘটে যায়
বসন্তের নিষেকে বর্ষা অঙ্কুর পায়।

কোন সৃষ্টির আগে বোধ হয় এমন বন্ধ্যাত্ব
মানুষ হয়ে ওঠার আগে বোধ হয় এমনি পশুত্ব!
আমরা ক্রমে ক্রমে মানুষ হয়ে ওঠার আগে তাই
পশুত্বের চরম সীমায় ....।

হয়তো কোন সৃষ্টি হবে বলেই এমনি ক'রে
মহাজাগতিক অতিমারি কোন এক কাক ভোরে
কোন এক অজানা নির্দেশিকা অগোচরে
অনুভবে নতুন সকাল চিনতে হবে নূতন ক'রে।

এই মহাজাগতিক প্রলয়ের মাঝে প্রশ্ন জাগে
এই জগতের অসীম লীলায় কতটুকু আমি?
নগণ্য অস্তিত্বের মাঝেও অপরিসীম ব্যাপ্তি
কখনো কখনো ভাবি কী হারিয়েছি আর কীই বা প্রাপ্তি!




হোমের কাঁঠালি কলা
         মম

প্রবীণা যত বলেন,
পুজোর হোমের কাঁঠালি কলা খেলে
গর্ভে সন্তান জন্মায়।
এই বিশ্বাসেই তাঁরা চলেন।
তাঁদের কথায় ও তা গেলে।
যদি ওর পেটে
একটি সন্তান জন্মায়।
বিয়ের পর গেছে কেটে
বারোটি বছর, সন্তান হয় নি।
এ জন্য ও কম নির্যাতন তো সয় নি।
কে কী না কু কথা কয় নি।
সব সয়েছে নীরবে।
কলাটি খায়,
ভাবে এবার ওর সন্তান ঠিক হবে।
দিন কেটে যায়।
পাঁচ মাস কাটে, ওর, কলা খাওয়ার পর।
বুঝলো পরিবর্তন এবার ও গর্ভবতী হওয়ার পর।
সবাই এখন ওকে সম্মান দেয়।
কাছে টেনে নেয়।






স্বপ্ন বালিকারে ভালোবেসে
          সাফরিদ সেখ

এই মাঠটা যদি পুরো আমার হয়?
কেবল আমি এর অধিকারী হই।

তাহলে, কি করবে তুমি?কি বুনবে তাতে?

কিনারা পর্যন্ত স্বপ্নের চারা বুনবো।
একে একে পূর্ণ করবো সারা মাঠ।
শান্তির ছেলেরা নিজ মনে খেলবে কেবল।
বছরের পর বছর শুনবো স্বপ্ন বালিকার
অনাবিল আনন্দ ধ্বনি, হিল্লোল।
স্বপ্ন বালিকা আমার পোষা ময়না হবে।
আমি তার পায়ে বেড়ি দেব না।
কেবলই আমার মাঠে থাকবে সে।
মাসের পর মাস বছরের পর বছর।
অনাবিল আনন্দের অনন্ত লোকের
স্বদেশ ভূমে থাকবে অসীম কে স্পর্শ করে।

আমি কি তোমার স্বপ্ন বালিকার
নরম হাত স্পর্শ করতে পারবো না?
তোমার স্বপ্নের পরিদের অধরে একবার
আলতো করে আমরা চিনুক রাখতে পারবো না?

তুমি সব পারবে ।তুমি সব পারবে।
তোমার জন্যই তো আমি স্বপ্ন বালিকার
এত ভালোবাসী।এত কাছে ডাকি।
তুমিই আমার স্বপ্নের রানী, গরিমা।
প্রেয়সী তোমাকে ভালো বেসে আমি স্বপ্ন বালিকারে
এত আপন করে পাই।এত নিবিড় অনুভবে।




0 comments: