শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২০

উপকণ্ঠ প্রাত্যহিক ওয়েব ম্যাগাজিন- 16/10/2020 (Upokontha)

 উপকণ্ঠ প্রাত্যহিক ওয়েব ম্যাগাজিন- 16/10/2020

 Upokontha sahitya patrika Web Megazine- 16/10/2020

Upokontha-16/10/2020


মিনতি গোস্বামীর দুটি কবিতা
(১)

প্রজাপতি প্রেম

আয়
আজ শুধু
হোক প্রজাপতি প্রেম
আমাকে ঘিরে উড়ে উড়ে
চলুক নীরবে অবাক মধুপ পান
এই প্রেমে থাকবেনা জানিস কোন শর্ত ।

বেহেস্ত জানিনা ভালোবাসি   ঘাম রক্তের মর্ত‍্য
মায়াবী জ‍্যোৎস্নায় গাই   ভালোবাসার গান
দীর্ঘ পথ  ঘুরে ঘুরে
জমিয়েছি নিকষিত হেম
কারা ধূধূ
গায়?

(২)

আগুন ঝাঁপ

বিপদ
সমূহ জেনেও
চলছে আগুন ঝাঁপ
মাস্কবিহীন আমরা ঘুরছি রোজ
ইচ্ছেমত  কেনাকাটার অছিলায় বাজারে বাজারে।
ভাইরাসকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছি কলার  তুলে।

সাময়িক সুখের লোভে মৃত‍্যুকে গেছি ভুলে
অথচ মৃত্যু  দেখছি হাজারে হাজারে
শবগন্ধ ভুলে বসাচ্ছি মহাভোজ
হারাচ্ছি পরিমিতির মাপ
খুঁজছিনা   হেরেও
নিরাপদ।



কথাশক্তি'
        মামনি পোড়‍্যা

কথায় আছে অনেক শক্তি
এই জীবনে থাকে যদি ভক্তি।
ভালো কথা আনন্দ দেয়
অন‍্যের জীবন সাজিয়ে দেয়।
খারাপ কথা দুঃখ দেয়
অনেকের জীবন ভেঙে দেয়।
জীবনে আনে আশা
কথায় যদি থাকে ভরসা।
কথা দিয়ে কথা রাখা
কর্নের ন‍্যায় সত‍্য থাকা।
কথায় হলে মনের জয়
কালিদাসও রইবে অক্ষয়।








চোখের জল সম্বল
                 সুস্মিতা দে

রেলের কান্ড কারখানা মানুষ পড়ছে বিপাকে ।ইঞ্জিন থামছে যেখানে সেখানে ।গত সপ্তাহে হাটবার ছিলো। অনেক দাম কম ছিলো ।
আজ নেমে গিয়ে দেখি জনতার ঢল কৃষকের চোখে  ভাসে শেষ সম্বল চোখের দামী  জল।

আর্তনাদে কান্নায় সাগর শুকিয়ে যায় ।তবুও বাঁচতে হবে ঘরে আছে স্ত্রী সন্তান মা বোন ছোটো আরো অনেক ভাইবোন।

আমি কৃষক কাণ্ডারী জীবনের তরী বহিতেই হবে , হোক তা কঠিন যতো ।
তবুও হাল ছাড়বোনা। চোরা বান ক্রমশ ঢুকছে , কাণ্ডারীর  সাহস বাড়ছে কূল দেখলেই  তরী ভিড়িয়ে দেবে কান্ডারী।

ঝড় তার বন্ধু না তাই তাকে লড়াই করতে হবে। একটি অস্ত্র  যুদ্ধ  যুদ্ধ কোন দিকে না  তাকিয়ে হাল ধরে আছে ধীরস্থির ভাবে।

শান্তো কান্ডারী খুশি ।ঝড় থামলো কিছু ডুবন্ত মানুষ কে নিজের তরী তে আনে কিনারা থেকে দেখে গ্রামের বাসিন্দারা  ইমার্জেন্সি বাস অটো যানবাহন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে ।খবর হাওয়াতে ভাসে, কতো মানুষ নদী তে ছিলেন।?    কে তা সকলের মন আতংক  আশংকা তে বুক ধুকপুক করে দাঁড়িয়ে আছেন । যাত্রীরা তো কারুর সন্তান কারুর মা ভাই বোন ।

কাণ্ডারী কৃষক ভাবে চাষবাস করবো আবার ধান উঠবে  তবে বিক্রি করবো না ধনী মানুষ দের কাছে দরাদরি করে তরকারি বেচবো না ,
তা একমাত্র কারন নয় ,আসল কারন মন চায় না কৃষক কাণ্ডারীর চাষের রক্ত ঝড়ানো কৃষকের পরিশ্রমের ধানে সম্মান ভালোবাসা যত্ন আছে। গ্রামবাসীদের  বিক্রি করবো । কাণ্ডারী কৃষক আপন মনে হাসে

,ধনী মানুষ কাগজের নোট খাক।  নিজের সাথে নিজে অঙ্গীকার করেন। কাণ্ডারি কৃষক চোখের জল আমার সম্বল তা সে আনন্দের হোক বা দুঃখের হোক,তাই দামী ,চোখের জল তার একান্ত একার সম্বল  ।





জাপান
       উমর ফারুক

এশিয়ার ক্ষুদ্রতম দেশ বলে
এক সময় বিদেশীদের কাছে অবহেলিত।
পাশ্চাত্যের প্রলোভন দৃষ্টি তাকে রুষ্ট করে।
জাপানে সম্পদে পরিপুষ্ট দেখে
ওরা জাহাজ নিয়ে ছুটে এসে
বানিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ।
পেরির গোপন চক্রান্তে জাপান
ভবিষ্যতে কয়েক যুগ এগিয়ে যায় ।
পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও সভ্যতা
আমদানি করে উভয়েই সমান হয়
এভাবে রণনীতিতেও শ্রেষ্ঠ হলে
চীন কে কোঁপায়
কোরিয়া কে কোঁপায়
রাশিয়া কে কোঁপায়।
এমনকি মার্কিন কেও ছাড়েনি হতচ্ছাড়া!!
এভাবে তাদেরকে বিপাকে ফেলে
নিজে বিপাকে পড়ে ।
পরিশেষে মার্কিন কে কোঁপাতে গিয়ে
নিজের মাথায় আঘাত হানে জাপান।






জ্বালিয়ে প্রদীপ
         বিপ্লব গোস্বামী

জ্বালিয়ে দ্বারে প্রদীপ শিখা
         ছড়িয়ে দিলাম আলো,
নাশিতে ধরার অশুভ শক্তি
         ঘুচাতে আঁধার কালো।

দিগন্ত পানে তাকিয়ে আছি
          নূতন কিছুর আশে,
আতঙ্ক-ত্রাস নিপাত যাক
          শান্তি আসুক শেষে।



বেদনার অশ্রু
    মোঃআলিউল হক

আমার চোখে আসে জল
পাপিষ্ঠ দের কান্ড দেখে
আঁখি ছল ছল।

পশুর চেয়ে হিংস্র যারা
মানব রূপী জন্তু তারা
বড়ই নিঠুর পাষাণ ওরা
খুন ধর্ষণ অবিরল।

রাজ শক্তির মদদ পেয়ে
হায়েনা হুঙ্কার চলে ধেয়ে
ধীরে ধীরে নিলো ছেয়ে
ধর্মীয় ঘৃণার কল।

ধর্মান্ধতা জাতের নামে
রক্ত খেলা খেলে রামে
মন্দ প্রভাব পরিণামে ;
দুষে সারা ধরাতল।

মহা মিলনের এই দেশে
বাঁচবো মোরা খেলে হেসে
ধর্ম বিদ্বেষ ঘাড়ে ব'সে
ঢেলে দেয় হলাহল।

কোন বিধানে আছে লেখা?
জাতের নামে বিভাজিকা!
সবল যবে প্রবল হবে -
মার খাবে দুর্বল।





মা এক জাতি
        সাফরিদ সেখ

আমি মা।সবিতা,কবিতার মা।
না আমি মা আলোক পলাশের ও।
তোমারা যত বড় হও  আমি কেবল
তোমাদের ডালিব আশীর্বাদ করিব দোয়া।
তোমরা মানুষের মতো মানুষ হও।
এই মোর প্রার্থনা ।আমি তোমাদের মা।

মা হিন্দুর,মা মুসলিমের জৈনের, মা ক্রিস্টানের।
সারা বিশ্বে মা এক জাতি।
এই জাতি বিশ্ব স্রষ্টা।জননী।

আমরা সদা ব্যস্ত থাকি দ্বন্দ্ব নিয়ে
কিসের দ্বন্দ্ব কিসের বিভেদ আজ
আমরা এক দেশ এক মার সন্তান।
মা এক জাতি ।আমরা এক  জ্ঞাতি।






সবুজের অভাব 
            আব্দুল রাহাজ

প্রকৃতির বুকে সবুজায়ন মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করে ফুটিয়ে তোলে তার মায়া সৌন্দর্য সকল মানবজাতির সম্মুখে। গ্রাম হয়ে ওঠে রূপকথার দেশ সবুজায়ন কে ঘিরে স্বপ্ন দেখে মায়াবিদেশ।
কিন্তু আহা কার বর্তমান সময়ে সবুজ হয়ে উঠেছে লিক লিক রোগা গ্রস্থ হয়ে উঠেছে লিকলিক গাছ থেকে মোটা গাছগুলি। মানুষ হয়ে উঠেছে দানব শীল  হচ্ছে সবুজের নষ্ট।
আর বিদায় নিচ্ছে সবুজের সাম্রাজ্য।






            হৃদয়ভূমি                
                 হামিদুল ইসলাম

মল্লযুদ্ধের ইতিহাস সাজাই
আমার হাত স্পর্শ করো
আজ আর কোনো যুদ্ধাস্ত্র রাখি না হাতে
হাতের বাজুতে বনস্পতির মূল
এখন ঝড়ে গাছ আর উপড়ে পড়ে না  ।।

বাকযুদ্ধের মধ‍্যে জড়িয়ে পড়ি
আমি নিজে
এ যুদ্ধ ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত
কেটে ফেলে দুপক্ষের কথা
আমার বুক স্পর্শ করো অভিমান হারিয়ে যাবে এখনই   ।।

অনুভবের চৌকাঠ পেরিয়ে যাই
হাতের কাছে আগুন
পুড়ে যাচ্ছে কাঠ কয়লা নুন ও জল
আমার হৃদয় ছুঁয়ে দেখো
সেখানেও তুমি। তোমার অবয়ব  ।।

এতোকাল পর
হা হুতাশ করে আর কি লাভ
মনের বন্ধনে আবদ্ধ জীবন
সোনালী সকাল। পাখিদের আকাশ
এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছে আমার হৃদয়ভুমি   ।।






অলসতা
         জুয়েল রূহানী

অলস সময় পার করে আর
কীই বা হবে বসে থেকে?
তার চে বরং খেলার মাঠে-
হাসি মনে যাবে ছুটে।

ঘরের দুয়ার বন্ধ রেখে-
কি আর হবে বসে থেকে?
এর চে বরং বটের ছাঁয়ায়
সময় কাটাও ছঁবি এঁকে।

অলস সময় পার না করে
সময় কাটাও কাজে,
কাজ না জানো, জানতে কভূ-
তুমি ঢাকবে না মুখ লাজে।







অনুকবিতা
            শংকর হালদার

০১।
তোমায় পেয়ে গোপন যত সাধ
মেলে ধরে আপন ঢঙে ,
শরম ভুলে...
তব রঙে রাঙিয়ে তুলি ...
রজ্জুহীন এ কোন  মায়া !

০২।
মন কাননে উঠলে ফুটে ফুল
তোমায় দেবো অঞ্জলি,
আবেগী ধারায় কুসুম বাগে
ভালো -মন্দ হারিয়ে ফেলি ।






একটি শিশুর আকাঙ্ক্ষা
                নির্মল সরকার

ঐ যে সিঁড়ির উপরে বন্ধ ঘরের জানালা-
আজ খুলে দাও ,
কে আছো ?
খুলে দাও ।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ।
আমি দেখতে চাই ,ঐ তেজস্বী আলো ,
অন্ধকার ভেদ করিয়া আসবো
খুলবো সবার চোঁখ ।
হয়তো আমি ছোট্ট শিশু,
অবুজ তবে ভাবছো ।
একদিন তবে বড় হবো ,
দেখবে সবাই শ্রেষ্ঠ ।

      






কে আছে আর কারা নেই

             সত্যেন্দ্রনাথ পাইন


       আত্মা আছে---

চোখে দেখা যায় না। 

ভালো বাসা আছে, ভালোবাসা নাইবা পেলাম। 


আন্তর্জাতিক বিনোদন আছে

আত্মীয়তা নাই বা থাকলো

রক্ত আছে। লাল লাল রক্তের দাগ আছে। 

খুন হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খুনি বেমালুম ঘুরে বেড়াচ্ছে। 


প্রেম আছে। 

প্রত্যাখ্যান বেশি আছে

প্রত্যাশা আছে

 

আঘাতের সম্ভাবনা আছে

ভালোবাসা নাইবা থাকলো। 


জীবন আছে। 

মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বাঁচার চেষ্টা আছে

বেকার আছে

চাকরির জন্য হাহাকার আছে


লকডাউন হবার সম্ভাবনা আছে

লাখ লাখ শ্রমিকদের বিক্ষোভ আছে

মালিকের উদাসীনতা আছে। 

সরকারি অনুদান আছে

না পাবার সম্ভাবনা আছে

ডেডবডির জন্য মর্গ আছে

পোস্টমর্টেম আছে, 

 রিপোর্টিংয়ে ভুল আছে

ঘুষ দিলে চাকরি আছে। 


মানুষে মানুষে বিভেদ আছে

ক্রিকেট আছে

ফুটবল আছে

হাডুডু আছে

লটারি নামের জুয়া আছে

বড়লোক হবার সম্ভাবনা আছে। 

ফকির হবার সুযোগও আছে


স্বামী আছে, স্ত্রী আছে

ঝগড়া আছে

মেনে নেবার জন্য প্রতিদান নেই

পাগলামি আছে


কে আছে কে নেই

 

তবুও ক্ষমতাহীন শ্বাস নিতে হাসপাতালে ভর্তি হবার ঝামেলা আছে। 


মানুষ কিনা ভেবে দেখবার সমস্যা আছে

 

রাস্তার মাঝে বঙ্গজ কুকুরের সঙ্গম আছে

করোনা ভাইরাস আছে

ব্যাঙ্কের প্রতারণা আছে

মোবাইলে এসএমএস আছে

অসম্মান করার প্রবণতা আছে। 


আলো আছে, অন্ধকার আছে


প্রজাপতি আছে, জোনাকি আছে

রঙীন স্বপ্ন আছে, আলোর ব্যাখ্যা নেই। 


কাকে ডাকবো? 

কে করবে আমার হয়ে ডাকাতি? 

তার চেয়ে

চুপ করে থাকাই ভালো। 

পুরস্কার অর্জন করার ইচ্ছা আছে

রামকৃষ্ণ হতে  মানসিক প্রস্তুতির অভাব আছে। 


বিবেকানন্দের বাণী আওড়ে বক্তৃতা করার ইচ্ছা আছে


স্বামীজী হবার মানসিক ইচ্ছা নেই। 


ঝগড়া আছে, 

বলো হরি হরিবোল ধ্বনি আছে। 


সংসার আছে শ্মশান আছে গোরস্থান আছে

জাত আছে বেজাত আছে


ধর্মের মধ্য বিভেদ আছে


মানুষ কে ভালোভাবে বুঝতে পারার চেষ্টা নেই। 


এসময় চলো যাই পর্বত গুহায়

সকলে মিলে মুক্তির পথ খুঁজি। 








ধারাবাহিক প্রবন্ধ
  কবিতার রূপকল্প  : পর্ব : ২৪

|জীবনানন্দ পরবর্তীকাল ও আধুনিক কবিতার আন্দোলন |      
                   সৌম্য ঘোষ

                     বিভাজনের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা লাভের ফলে অখন্ড বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । বাংলার পূর্ব অংশ হলো পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানি বা ইসলামী আদর্শের গণ্ডিবদ্ধতা বাংলা সাহিত্যকে আচ্ছন্ন করে দিল। স্বৈরশাসকরা সেখানে জোরপূর্বক উর্দু চাপাবার চেষ্টা করল। ফলে সেখানে মাতৃভাষার কন্ঠরোধে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গর্জে উঠল । শুরু হল মাতৃভাষার ন্যায্য অধিকার রক্ষার আন্দোলন ।  এই আন্দোলন প্রসঙ্গে আমি একটি পৃথক পর্ব পরে আলোচনা করব ।
             মাতৃভাষার পরিবর্তে জোরপূর্বক উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার এই যে পাকিস্তানি অপচেষ্টা তার বিরুদ্ধে কবি-সাহিত্যিকরাও গর্জে উঠলেন । কারণ তাঁরাও ভাষাশিল্পী । পঞ্চাশের দশক থেকে যখন পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিকরা রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলেন , সেই সময় অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকরা রাজনীতির সংঘর্ষে যুক্ত হলেন। পূর্ববঙ্গের কবিতা রাজনীতি সচেতন, প্রতিবাদী, দেশের মৃত্তিকার গন্ধে মদির । পশ্চিমবঙ্গের কবিতা যতটা নাগরিক , পূর্ববঙ্গের কবিতায় আমরা পাই গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য ও দেশের মৃত্তিকার মদির গন্ধ।

                  পঞ্চাশ দশকে পূর্ব বাংলার কবিতাকে যাঁরা ঋদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান
শামসুর রাহমান , সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, আজিজুল হক, আলাউদ্দিন আল্ আজাদ , আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ , আবু বকর সিদ্দিকী , মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, দিলওয়ার প্রভৃতি।
           পরবর্তী পর্বে এলেন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন শক্তিমান কবিগণ ‌। যেমন, শহীদ কাদেরী, আসাদ চৌধুরী , রফিক আজাদ , আবদুল মান্নান সৈয়দ , মোহাম্মদ রফিক  ইত্যাদি।
         আরো পরবর্তী সময়ে আমরা পাই প্রতিভাবান কবিদের:  মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, সানাউল হক খান, মূহম্মদ নুরুল হুদা, শিহাব সরকার ইত্যাদি ইত্যাদি।
        পূর্ব বাংলায় বাংলা কবিতায় প্রতিভাবান কবিদের ' সুজলাং সুফলাং' ।‌ তাই হয়তো অনেক নাম বাদ পড়ে গেল, তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চর্চা আমরা পড়ার মাধ্যমে জানতে পারি, তা এককথায় অভাবনীয় । আমি  অবনত শ্রদ্ধাশীল ।

              শামসুর রাহমান (১৯২৯-- ২০০৬)
              ____________________________

               শামসুর রাহমান বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে দুই বাংলায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত। তিনি একজন নাগরিক কবি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয়। তিনি 'মজলুম আদিব' ছদ্মনামে লিখতেন। শামসুর রাহমানের ডাকনাম বাচ্চু। তিনি, বৈদগ্ধ সবচেয়ে আধুনিকবাদী। তিনি যেমন রোমান্টিক,  তেমনি তাঁর মধ্যে আছে 'যন্ত্রনার সম্ভব আত্মানুসন্ধান' ।
শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন 'হাতির শুঁড়' নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা 'টেলেমেকাস'। রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা "দৈনিক পাকিস্তান" এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরও স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দিন , বেগম সুফিয়া কামাল ইত্যাদি ।  ১৯৬৮ সালে  পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে কবি লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহিদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিক ভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদির পাড়াতলি গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা 'স্বাধীনতা তুমি' ও 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা'।  শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডুক মৌলবাদীরা। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এত কিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।
শামসুর রহমানের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। তিনি ৪টি উপন্যাসও লিখেছেন। অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কবি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনন্দ পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং যাদবপুর ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট।

               সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৩--২০১৬  )
             ____________________________

          সৈয়দ শামসুল হক বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রখ্যাত  সাহিত্যিক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাঁকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। তাঁর লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছর ব্যাপী বিস্তৃত। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। 
                              কথিত আছে , সাহিত্যে শক্তিশালী মাধ্যম নাকি কবিতা। এই কবিতার ক্ষেত্রেও সৈয়দ শামসুল হক তাঁর স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। কালক্রমে প্রকাশিত হয় 'বিরতিহীন উৎসব' (১৯৬৯), 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' (১৯৭০), 'প্রতিধ্বনিগণ' (১৯৭৩), 'অপর পুরুষ' (১৯৭৮), 'পরাণের গহীন ভিতর' (১৯৮০), 'রজ্জুপথে চলেছি' (১৯৮৮), 'বেজান শহরের জন্য কোরাস' (১৯৮৯), 'এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি' (১৯৮৯), 'অগ্নি ও জলের কবিতা' (১৯৮৯), 'কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে' (১৯৯০), 'আমি জন্মগ্রহণ করিনি' (১৯৯০), 'তোরাপের ভাই' (১৯৯০), 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৯০), 'নাভিমূলে ভস্মাধার' (১৯৯০) ইত্যাদি। তাঁর কবিতায় ফুটে উঠে বাকপ্রতিমা নির্মাণ ও বাকপটুতা।

                    হাসান হাফিজুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি মূলতঃ সামাজিক । দেশ চেতনা এই কবিকে প্রাণিত করে । আজিজুল হক সংবেদনশীল কবি । রচনাশৈলী তে তিনি খুবই নিপুণ ।‌ ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতায় আছে গভীর দেশ ও চেতনা ও মানুষের সংগ্রামের কথা।

                      শহীদ কাদরী  ( ১৯৪২--২০১৬)
                 ________________________________

                      শহীদ কাদরী ছিলেন  কবি ও লেখক। তিনি ১৯৪৭-পরবর্তীকালের বাঙালি কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যিনি নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন।                    
শহীদ কাদরী (১৯৪২-২০১৬) লিখেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু লিখেছেন খুবই অল্প। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চার। এই চারটি গ্রন্থে কবিতা রয়েছে ১৫০টির মতো। 
          সৃষ্টি-সংখ্যা দিয়ে তাঁর
কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তাঁর সৃষ্টিটাই আসল। পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই অল্প। যেমন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। আর একজন বিখ্যাত কবি জঁ আর্তুর র্যাঁবো। তাঁর বই মাত্র দুটি।

               আসাদ চৌধুরী ( ১৯ ৪৩)
             ________________________

                      তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তাঁর ব্যঙ্গার্থক কবিতা 'কোথায় পালালো সত্য' একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধোগতি, তারই প্রেক্ষাপটে একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন :

"তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

এখন আছি অল্প।"

                   রফিক আজাদ (১৯৪২-- ২০১৬)
                 ______________________________

                   রফিক আজাদ ছিলেন একজন  আধুনিক কবি। ২০১৩ সালে তিনি সাহিত্যে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা সাহিত্যে আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন ।  তিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বিভিন্ন সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা করেছেন এবং জীবিকাসূত্রে সরকারি চাকুরিও করেছেন। 
                       রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার মধ্যে নারীপ্রেমের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে — ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘সশস্ত্র সুন্দর’, ‘এক জীবনে, ভালোবাসার কবিতা’ প্রভৃতি।
                 
                                      তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা হলো ‘ভাত দে হারামজাদা’। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এ কবিতা দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে বৈশ্বিক হতে পেরেছে এর সার্বজনীন আবেদনের কারণে। অন্তরের তাগিদে কোনো কবিতা রচিত হলে তার ফলাফল এরকমই হয়; নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছিল। কবিতা কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় ও মৃত্তিকাকে বুকে ধারণ করে সৃজিত হয় বটে; কিন্তু তা যদি শিল্পের মানদন্ডে একবার টিকে যায় তাহলে সাম্প্রতিকতার তুচ্ছতা সে-কবিতাকে গ্রাস করতে পারে না কিছুতেই।
                      তাঁর সেই কালজয়ী কবিতার কিছু অংশ :

           ভাত  দে   হারামজাদা
      ___________________________

    "ভীষণ ক্ষুধার্ত আছি: উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে—প্রতিপলে—সর্বগ্রাসী ক্ষুধা!
অনাবৃষ্টি—যেমন চৈত্রের শস্যক্ষেত্রে—জ্বেলে দ্যায়
প্রভূত দাহন—তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ।

দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবী,
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি, টাকা কড়ি—কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবী: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর—
.....           .......       ......        ......         ......

অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি, নেই যৌনক্ষুধা—
চাই নি তো: নাভিনিম্নে-পরা শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক—যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও—
জেনে রাখো: আমার ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন—

......... .......     ....... ‌........       ....... ‌........

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী—
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি—
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।

ভাত দে হারামজাদা, তা না-হ’লে মানচিত্র খাবো।

                   মহাদেব সাহা
               _______________

                   মহাদেব সাহা ( ১৯৪৪-)।  
                   বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালের একজন অন্যতম প্রধান কবি। তিনি তাঁর সাহিত্যিক অবদান দিয়ে সব ধরনের পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তিনি রোম্যান্টিক গীতিকবিতার জন্য জনপ্রিয়। তাঁর কবিতা অপরিশ্রুত আবেগের ঘনীভূত প্রকাশে তীব্র। তিনি জীবিকাসূত্রে একজন সাংবাদিক ছিলেন, এবং দীর্ঘকাল 'দৈনিক ইত্তেফাক' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৬ থেকে তিনি কানাডা প্রবাসী।
                 দুবার স্বাধীনতার স্বাদ। একবার ১৯৪৭ সালে , পরে আবার ১৯৭১ সালে। সাম্প্রতিককালের মধ্যে দুইবার পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধীন হওয়ায় এই দেশের কবিদের কবিতায় স্বদেশ চেতনার  কথা ফিরে ফিরে আসে । এসেছে মহাদেব সাহার কবিতা দেও । তাঁর কবিতায় আরো পাই আত্মমগ্ন প্রেমের কথা। তাঁর কবিতা :

"কেউ জানেনা একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর
দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন
প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল
সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস,
এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!.......... "

                   নির্মলেন্দু গুণ
                _______________
              নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫-)
             
               নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী,  যিনি নির্মলেন্দু গুণ নামে ব্যাপক পরিচিত, একজন  কবি এবং চিত্রশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তার কবিতায় মূলত নারীপ্রেম, শ্রেণি-সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধিতা, এ-বিষয়সমূহ প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রেমাংশুর রক্ত চাই'  প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা ' হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। । তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার , ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন।

নির্মলেন্দু গুণের কবিতা :

" বুকের উপরে তুমি খঞ্জর হাতে বসে আছো সীমারের মতাে।

ক্যামেলিয়া, তুমিও কি ব্যর্থ-প্রেম? তুমিও কি প্রেমের সীমার?

তােমার উদ্ধত খঞ্জর আমার চৌচির বক্ষে কোন্ অপরাধে?

এ-বুকে কিছুই নেই, কিছু নেই, জীবনের ব্যর্থ-প্রেম ছাড়া।

তুমি ভুল করে বসেছ এখানে, তুমি ভুল হাতে তুলেছাে খঞ্জর। 

রসুলপ্রতিম তুমি আমাকে চুম্বন করাে – , আমি লক্ষ লক্ষ প্রেমে 

ব্যর্থ হয়ে, ব্যর্থ হতে হতে পৃথিবীর ব্যর্থতম প্রেমিকের মতাে 

ঈশ্বরের সম্মুখে গিয়েছি, ছুঁয়েছি নিজের মুখ, আত্ম-প্রতিকৃতি; ..... ........ "

                   আবুল হাসান
                  _____________
               আবুল হাসান ( ১৯৪৭--৭৫)।
               আবুল হাসানের কবিতায় সমকালের সংকট আর বৈরী পারিপার্শের কথা। তিনি বলেন, 
" অসুখ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অন্ধকার ।"
                     তিনি একজন আধুনিক কবি যিনি ষাটের দশকের সঙ্গে চিহ্নিত। পেশায়  সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া আর সাহিত্যিক নাম আবুল হাসান। তিনি ষাটের দশকের জনপ্রিয় কবিদের একজন এবং সত্তরের দশকে গীতল কবিতার জন্য উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক অর্জন  করেন ।
                      
                        মধ্যষাটের দিকে আধুনিক বাংলা কবিতার যুবরাজ কবি আবুল হাসানের আগমন ঘটে। সময়টি ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকাল, দুঃসহ সময়। অন্যদিকে তখন থেকেই শুরু হয় বাঙালি রেনেসাঁসের পুনরুজ্জীবন বা নতুন করে পথচলা। কারণ ’৫২-এর মহান ভাষা-আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছিল একটি একক জাতিসত্তাবোধ, পূর্ণাঙ্গ ও পরিশুদ্ধ ভাবনা। আর সেই ভাবনা থেকে ব্যক্তি ও কবি আবুল হাসান কখনো পৃথক ছিলেন না। আর এই ভাবনাকে ধারণ করে ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে শামসুর রাহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুল হক ও মোহাম্মদ রফিকরা তৎকালীন সময়ের চলমান ঘটনা ধারণ করে কবিতার নির্মাণশৈলীতে ভিন্ন-ভিন্ন উচ্চারণ করেন। তাঁদের কারো কারো কবিতা ছিল অনেক বেশি স্লোগানধর্মী ও আবেগতাড়িত। পরবর্তীকালে তাঁদের অনেকের কবিতার বিষয় ও শৈলী পরিবর্তিত হয়েছে। পক্ষান্তরে কবি আবুল হাসান কবিতার শব্দচয়নে স্লোগানধর্মিতা এড়িয়ে নান্দনিকতার ছোঁয়ায় প্রতিবাদের ভাষাকে আরো বেশি উজ্জীবিত করতেন। কবি আবুল হাসান সমকালীন সময়ের চিত্র অাঁকতে গিয়ে ইজমপ্রধান হয়ে ওঠেননি। অর্থাৎ কবি আবুল হাসান আবেগকে প্রশমন করতে না পারলেও লেখনীকে প্রশমিত করতেন উপমা ও রূপকের সূক্ষ্ম কারুকার্যে। আর এ-কারণেই দেখি তাঁর নান্দনিক প্রতিবাদ –

  " যদি দেখি না
পৃথিবীর কোথাও এখন আর যুদ্ধ নেই, ঘৃণা নেই, ক্ষয়ক্ষতি নেই তাহলেই হাসতে হাসতে যে যার আপন ঘরে
আমরাও ফিরে যেতে পারি।"

                      এইভাবে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সমান্তরালভাবে একযোগে পূর্ববঙ্গ তথা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে বাংলা কবিতা লেখা হয়েছে পরম্পরা ক্রমে ।







0 comments: